সর্বাতমুখী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরে (১৮৬১-১৯৪১) প্রতিভার বিকাশ পর্যায়ে ও মানস বিবর্তনের এক বিশেষ লগ্নে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে স্মর্তব্য সৃজন হলো ‘গীতাঞ্জলি’, ‘গীতলিপি’, ‘গোরা’ এবং ‘রাজা’। এসময় তিনি অরূপ সাধনায় নিবেদিত এবং নিসর্গ আশ্রিত অরূপ; প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যবর্তী হয়ে তাঁর মানসে অবস্থান নিয়েছে। অসীমের উপলব্ধিও বিচিত্র বর্ণে উদ্ভাসিত হয়েছে। পাশাপাশি সেই উপলব্ধিও কবি হৃদয়ের সাথে নিগূঢ় সম্পৃক্তি ঘটেছে।

 

ওই উপলদ্ধিজাত চিন্তা থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘রাজা’ নাটকে উপস্থাপন করলেন স্বীয় অরূপ তত্ত¡কে। এখানে দেখালেন রানী সুদর্শনা বাহ্যিক রূপ ও সৌন্দর্যের মধ্যে সুন্দরের অতীত অপরূপকে সন্ধান করেছিলেন, যা বস্তুত তার মোহ। কারণ যিনি বিশেষ রূপ, স্থান ও দ্রব্যে নেই, তাকে রূপের মধ্যে সন্ধান করা ভ্রম। রানীর মোহ ও ভ্রমের ফলে, রানী নিজের চতুর্দিকে তীব্র জ্বালাময় অগ্নিদহের সৃষ্টি করেছেন। এই দাহে তার মিথ্যা অভিমান ও ভ্রান্ত মোহ ভষ্মসাৎ হয়ে গেল এবং তার অভ্যন্তরীণ সত্যেভপলব্ধি উজ্জ্বল দীপ্তিতে ভাস্বর হয়ে উঠলো। তখন রানী সুদর্শনা রূপকে বুটতে পারলেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় এ রূপ হলো- ‘ননীর মতো কোমল, শিরীষ ফুলের মতো কালো,- কুলশূন্য সমুদ্রের মতো কালো, তারই তুফানের উপরে সন্ধ্যার রক্তিমা’।

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাটকে দেখিয়েছেন এই রূপাতীত সৌন্দর্যকে কেবল উপলব্ধি করা যায়, স্বীয় চিত্তকে দুঃখ তাপে পরিশুদ্ধ করার পর। তাই বিপদ ও দুর্যোগের মধ্যেই সুদর্শনা অন্ধকার গৃহের রাজার সন্ধান পেয়েছে। এই অরূপতত্ত¡টির কথা রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘খেয়া’ (১৯০৬) কাব্যের ‘আগমন’

কবিতায়ও বলেছেন-

 

ওরে দুয়ার খুলে দে রে

বাজা শঙ্খ বাজা,

গভীর রাতে এসেছে আজ

আঁধার ঘরের রাজা।

বজ্রডাকে শূন্যতলে,

বিদ্যুতেরি ঝিলিক ঝলে,

ছিন্ন শয়ন টেনে এনে

আঙিনা তোর সাজা,

ঝড়ের সাথে হঠাৎ এল দুঃখ রাতের রাজা।

 

‘খেয়া’ ও ‘রাজা’র এই তত্ত¡টিকে রবীন্দ্রনাথ আরো ব্যাপক ও বিস্তৃত করে উপস্থাপন করেছেন ‘রাজা’-র রূপান্তরিত ‘অরূপরতন’ (১৯২০)-এ।

 

প্রকৃতপক্ষে ‘রাজা’ নাটকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দুটি তত্তে¡র কথা বলেছেন। এক. অরূপের মধ্যে রূপের সন্ধান, দুই. দুর্গম দুঃখময় পথ অতিক্রম করতে পারলেই সত্য ও ত্রেয়কে পাওয়া যাবে। অর্থাৎ সাধনায় সিদ্ধি লাভ। নাটকের কাহিনীতে দেখা যায়, সুরঙ্গমা ও ঠাকুর দা’ রাজার অরূপের মধ্যে রূপের সন্ধান পেয়েছে কেবল সাধনার দ্বারা। আর সুদর্শনা রূপের মধ্যে আবিষ্কার করতে গিয়ে বিভ্রান্ত হয়েছে, সুবর্ণর প্রতি মোহান্ধ হয়েছে এবং কাঞ্চীরাজের দ্বারা দগ্ধ হয়েছে। এই অরূপ তত্তে¡র বাইরে ‘রাজা’ নাটকে ভক্ত-ভগবানের অবিচ্ছেদ্য প্রণয়াসক্ত বন্ধনের তত্ত¡ অর্থাৎ হিন্দুর বৈষ্ণবতত্ত¡, মুসলমানের সুিফবাদ ও খ্রিস্টানের মিস্টিক মতবাদের প্রভাবও আছে।

 

এ নাটকের কাহিনী বিন্যাসে সুদর্শনাকে আশ্রয় করে যে ট্র্যাজেডির সুর বেজেছে তাও তত্তে¡র আলোকে। তাই দেখা যায়, রানী সুদর্শনা অরূপকে বাদ দিয়ে রূপকে চায় এবং রাজাকে রূপের মধ্যে নিয়ত সক্রিয় প্রবল পুরুষ ভেবে প্রত্যাশা করে বলেই তার ভ্রম হয়।

 

সুদর্শনা

… তুমি আমাকে জোর করে ধরে রাখতে পারতে কিন্তু রাখলে না। আমাকে বাঁধলে না- আমি চল্লুম। তোমার প্রহরীদের হুকুম দাও আমাকে ঠেকাক।

 

রানী সুদর্শনার সে ভ্রমের সুযোগে দুই খল আবির্ভূত হয় নাটকে। একজন খল সুবর্ণ, অপরজন কাঞ্চীরাজ। রানীকে সুবর্ণ চায় গান্ধর্ব মতে এবং কাঞ্চীরাজ চায় রাক্ষস মতে। অবশ্য ভক্তের দুুর্দিনে ভগবান চুপ করে থাকতে পারে না বলে তিনি আসেন এবং ভক্তকে রক্ষা করেন। সুদর্শনার সব অভিমান পরিত্যক্ত হলো এবং অপরাধ মার্জনা হবার পর তার সাধনায় সিদ্ধি লাভ হয়। অর্থাৎ অরূপতত্তে¡ই নাটকের শৈল্পীক ট্রাজিক পরিণতি।

 

‘রাজা’ নাটকের প্রথম মঞ্চায়ন হয় কলিকাতায় ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে। তখন ন্যাশনাল থিয়েটারে কুমুদনাথ চট্টপাধ্যাধায়ের ‘স্বর্ণ প্রতিমা’ (২৪.০৯.১৯১০), কোহিনূর মঞ্চে ক্ষীরোদ প্রসাদ বিদ্যাবিনোদের নাটক ‘বাংলার মসনদ’ (১.১০.১৯১০), স্টার মঞ্চে গিরিশিচন্দ্র  ঘোষের ‘শংকরাচার্য’ (১২.১১.১৯১০), মিনির্ভা মঞ্চে গোপাল চন্দ্র লাহিড়ীর ‘অশোক’ (৩.১২.১৯১০) প্রভৃতি জনপ্রিয় নাটক অভিনীত হয়। এসব নটেকের নির্দেশনা দিচ্ছেন গিরিশ ঘোষ, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি, অমৃতলাল বসুর মতো স্বনামখ্যাত নাট্যজনেরা। ঐসব নাটকের অভিনেতারা অভিনয় করে দর্শকদের মাতিয়ে রাখতেন। সে সময় ঠাকুরবাড়িতে ‘রাজা’-র মঞ্চায়ন ও অভিনয় দর্শকদের এবং স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের মনোরঞ্জন করতে পারে নি। এমন কি নাট্যবিষয় ও তত্ত¡টি ঠিক মতো পরিবেশন করা যায় নি। ফলে যে দর্শক কোহিনূর, মিনার্ভা, স্টার বা ন্যাশনালে নাটক দেখছেন, তাদের প্রত্যাশা ‘রাজা’ দেখে পূরণ হতো না বলে ‘রাজা’ সমকালে যথার্থ মর্যাদা পায় নি। ‘রাজা’-র মঞ্চায়ন নিয়ে রবীন্দ্রনাথের আক্ষেপ থাকারই কথা। ছিলও তাই।

 

পরবর্তীকালে যে-সকল নাট্যমোদী ‘রাজা’ নাটকটি পাঠ করেছেন তারা এর অভিনয় দেখার আকাক্সক্ষা করেছেন। তাদের কেউ কেউ অভিনয় কখনো দেখেছেনও। তবে তাদের অধিকাংশেরই এ বিষয়ে অতৃপ্তি থেকেছে। এমন কথা সে-সময়ের পত্র-পত্রিকায় বেশ লেখা হয়েছিল।

 

সম্প্রতি ঢাকার মঞ্চে রচনা ও প্রথম মঞ্চায়নের প্রায় শতবর্ষ পরে ‘রাজা’ মঞ্চায়ন করেছে নাট্যদল প্রাচ্যনাট। এই ‘রাজা’-য় কতটুকু রবীন্দ্র ‘রাজা’-কে খুঁজে পাওয়া যায় এবং এ ‘রাজা’ শতবর্ষ পশ্চাতের হতাশাব্যঞ্জক ‘রাজা’-কে অতিক্রম করে কতটুকু মঞ্চসফল ও দর্শকনন্দিত হতে পেরেছে- এ বিষয়টি মূল্যায়নের দাবি রাখে।

 

প্রাচ্যনাটের চতুর্দশ প্রযোজনা আজাদ আবুল কালাম নির্দেশিত ‘রাজা এবং অন্যান্য…’। প্রচলিত মঞ্চনাটকের উপকরণের সাথে আধুুনিক প্রযুক্তির সংমিশ্রণে, নাট্যবিষয়ের নবতর ব্যাখ্যায় এবং পরিবেশনার নবীন কৌশলে ‘রাজা এবং অন্যান্য…’ হয়ে উঠেছে এক অনন্য নির্মাণ। সর্বাগ্রে এর অসাধারণত্ব লক্ষ্য করা যায় নাট্যবিষয়ের নবতর ব্যাখ্যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘রাজা’ নাটকে খল কাঞ্চীরাজ ও তার সহযোগী ৬ দুষ্টু রাজাকে দেখিযেছেন। আর আজাদ আবুল কালাম সেখানে দেখিয়েছেন মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদসহ আধিপত্যবাদী ৬ রাষ্ট্রনেতাকে- যারা ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরীণ সংকট ও অশান্তির কারণ। এবং তারা বিশ্বব্যাপী নৈরাজ্য বিস্তার করছে।

 

আজকের বিশ্বরাজনীতির দিকে তাকালে দেখা যাবে যে, মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ এবং তার দোসর রাষ্ট্রসমূহ কী করে অন্যান্য রাষ্ট্রের অর্থনীতি ও সম্পদকে গ্রাস করার জন্য রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। ¯œায়যুদ্ধের অবসানের পর অর্থাৎ সোভিয়েট ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ভাঙনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়ে উঠেছে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী এবং বিশ্বরাজনীতিতে অসীম ক্ষমতাশালী ও অপ্রতিদ্ব›দ্বী মোড়ল। যার আকাক্সক্ষার কাছে অন্য সকলকে আতœসমর্পন করতে হয়। যার প্রত্যশায় অন্যদের পতন অনিবার্য হয়। প্রাচ্যনাটের ‘রাজা এবং অন্যান্য…’ নাটকে কাঞ্চীরাজকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ক্ষমতাশালী ও আধিপত্যবাদী চরিত্রে পরিস্ফুট করা হয়েছে। পাশাপাশি তার সহযোগী রাষ্ট্র ও রাজনীতিকদেরকে বিশেষ বৈশিষ্ট্যমÐিত করে উপস্থিত করা হয়েছে। যেমন- হিটলার, লাদেন, ভারত, রাশিয়া ইত্যাদি। এসব রাষ্ট্রের বা রাজনীতিকদের চরিত্রকে তাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা বা শ্রেণীচরিত্রের আলোকে এবং রাজনৈতিক দর্শনের ছায়ায় উপস্থিত করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে ইতিহাস, অতীত, ঐতিহ্য এবং সমকাল নাট্যক্রিয়ায় উপাদান হিসেবে যুক্ত হয়ে নবতর নাট্যব্যাখ্যাকে সুস্পষ্ট করেছে। ফলে মূলের রাজাগণ দৃশ্যকাব্যের অরূপ থেকে উঠে এসে রূপের চরিত্রে স্বচ্ছ হয়ে বিশ্বরাজনীতির নাটকে রূপান্তরিত হয়েছে। এখানে মূল রাজার নবতর ব্যাখ্যায় মঞ্চায়ন। এখানেই ‘রাজা এবং অন্যান্য…’ নাটকের স্বাতন্ত্র্য ও সাফল্য। নাটকে দেখা যায় রানী সুদর্শনা যখন স্বীয় রাজাকে ত্যাগ করে মুক্ত হয়ে পিতৃগৃহে যায়, তখন কাঞ্চীরাজ তাকে পাওয়ার জন্য অস্থির হয় এবং যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেয়। এই অন্যায় যুদ্ধে অন্য রাজারা সাহায্য করে। এদৃশ্য নবতরভাবে মঞ্চে উপস্থাপিত হলে মনে হওয়া অসঙ্গত নয় যে, এ ইরাক দখলের জন্য মার্কিনীদের আরোপিত যুদ্ধেরই চিত্র। আর মনে হয় বলে মঞ্চে যখন রানী সুদর্শনাকে দখলের জন্য কাঞ্চীরাজসহ অন্য রাজাদের আস্ফালন চলছে, তখন মঞ্চের দুই পাশের পর্দায় দেখা যায় টুইন টাওয়ার ভেঙে পড়ার দৃশ্য ও ইরাক দখলের মার্কিনী আগ্রাসনের ছবি। মঞ্চের কাঞ্চীরাজ আর পর্দার যুক্তরাষ্ট্রের দৃশ্যাবলি দেখে দর্শকের মন আর চোখ একাত্ম হয়ে যায় যুদ্ধবিরোধী চেতনায়। ‘রাজা এবং অন্যান্য…’ নাটকের বোধকরি সার্থকতা এখানেই।

 

‘রাজা এবং অন্যান্য…’ নাটকের বিপন্ন সুদর্শনা দর্শকের কাছে হয়ে ওঠে আক্রান্ত ইরাক। যার বিপুল তেলসম্পদ এবং রাষ্ট্রনেতার অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তের কারণে সা¤্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর দ্বারা আক্রান্ত হয়। সেখানে সাধারণ জনতা নিষ্ঠুরতার স্বীকার হয়। রাষ্ট্রযন্ত্রের কুটনৈতিক ব্যর্থতা কিংবা সা¤্রাজ্যবাদের আধিপত্যবাদী মানসিকতার কারণে এই রাজনৈতিক বিভ্রম ও বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়। অপরদিকে বলা যায় রানী সুদর্শনার সৌন্দর্যই তার বিপদের কারণ, যেমন ইরাকের তেলসম্পদই তার সংকটের কারণ। এই নাটকে কাঞ্চীরাজের ঔদ্ধত্য, অবিনয় এবং সর্বগ্রাসী মানসিকতার প্রতিফলন বিশ্বরাজনীতির ঐ সংকটময় চরিত্রকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। ফলে রূপক নাটক বা সাংকেতিক নাটকের অরূপতত্তে¡র এক নতুন ব্যাখ্যা রূপময় হয়ে ওঠে। বৌদ্ধতন্ত্রের তাত্তি¡ক দর্শনকে রবীন্দ্রনাথ রূপময় করেছিলেন সুদর্শনা, রাজা, কাঞ্চীরাজকে আশ্রয় করে। সে কথা সত্যি। আর সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিশ্বব্যাপী আস্ফালন, অবিনীত আচরণ ও বিপন্ন ক্ষুদ্র রাষ্ট্রসমূহের অস্তিত্বের সংকট যখন প্রচ্যনাটের ‘রাজা এবং অন্যান্য…’-তে আজাদ আবুল কালামের নির্দেশনায় রূপময় হয়ে ওঠে; তখন তাও শিল্পমূল্য বিচারে অসত্য নয় বা অলীকও নয়। কারণ রবীন্দ্রনাথ যে অরূপের কথা বলেছেন, তার রূপময় প্রকাশ নির্দেশকের ভাবনায় নানা মাত্রিক হতেই পারে। এই হওয়াটি কখনোই বিচ্যুতি বা বিভ্রান্তি নয়। বরং বলা যায় নাটকের ক্ষেত্রে এই নবতর ব্যাখ্যা ও প্রকাশ যথার্থ ও সঙ্গত।

 

নাটকের এরকম নবতর ব্যাখ্যার রূপময় প্রকাশ লক্ষ্য করা যায় পিটার ব্রæকের অনেক নাটকে। ‘রাজা অদিপাউস’-র মঞ্চায়নেও এমন বিচিত্র রূপায়ণ দেখা যায়। বস্তুত নাট্যরচনায় যদি পরীক্ষা-নিরীক্ষা গ্রহণযোগ্য হয় তবে নির্দেশনা ও চরিত্র নির্মাণসহ সকল ক্ষেত্রেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা গ্রহণযোগ্য। এ বিবেচনায় ‘রাজা এবং অন্যান্য…’ নাটকের পরীক্ষা-নিরীক্ষা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নিজেই নাটকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন। যেমন রচনায়, তেমনি পরিবেশনায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাট্যকারের লেখার সাথে নির্দেশকের দেখানোর পার্থক্যকে বরাবরই স্বীকার করেছেন। তাই তিনি ‘রঙ্গমঞ্চ’ প্রবন্ধে বলেছেন- ‘বাগানকে যে অবিকল বাগান আাঁকিয়াই খাড়া করিতে হইবে … এরূপ অত্যন্ত স্থুল বিলাতি বর্বরতা পরিহার করিবার সময় আসিয়াছে’। এখানে তিনি নাট্যকারের রচনার সাথে দূরতম ঐক্যে প্রতিষ্ঠিত নির্দেশকের স্বাধীন চিন্তার পরীক্ষমূলক রূপায়ণকে সানন্দে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ফলে রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা’ নাটকের সাম্প্রতিকতম মঞ্চায়ন আজাদ আবুল কালাম নির্দেশিত ‘রাজা এবং অন্যান্য…’ এর ভিন্নমাত্রিক উপস্থাপনাও মর্যাদাপূর্ণ স্বীকৃতি দাবি করতে পারে।

 

‘রাজা এবং অন্যান্য…’ নাটকে ব্যবহৃত আধুনিক প্রযুক্তি বিশেষ করে প্রজেক্টর ব্যবহার এবং সেখানে মঞ্চে অভিনীত দৃশ্যাবলির সম্পূরক চিত্র প্রদর্শন করা হয়েছে। অর্থাৎ মঞ্চে আক্রান্ত সুদর্শনা বা বিপন্ন সুদর্শনার সাথে পর্দার টুইন টাওয়ার আক্রমণ, ইরাক-আফগানে আগ্রাসন ইত্যাদি দৃশ্য প্রদর্শন ঢাকার মঞ্চ নাটকে একেবারেই নতুন। একে অনেকটাই বাহুল্য বলে মনে হয়। সমকালীন পাশ্চাত্য মঞ্চনাটকে ব্যবহৃত উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের সাদৃশ্যে এ নাটকেও তা ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে নাটকটি বিষয়গুণে দর্শকদের মন ভরায় আর পরিবেশনার গুণে চোখ ধাঁধায়। এই প্রযুক্তিনির্ভর ও বাহুল্যময় পরিবেশনা অসঙ্গত নয়। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মঞ্চবাহুল্যকে বর্জনের পক্ষে মত দিয়েছিলেন। তিনি ‘তপতী’ (১৯২৯) নাটকের ভূমিকায় বলেন- ‘আধুনিক য়ুরোপীয় নাট্যমঞ্চের প্রসাধনের দৃশ্যপট একটা উপদ্রবরূপে প্রবেশ করেছে। ওটা ছেলেমানুষী। লোকের চোখ ভোলাবার চেষ্টা। সাহিত্য ও নাট্যকলার মাঝখানে ওটা গায়ের জোরে প্রক্ষিপ্ত’। কিন্তু নাটক যখন ‘রাজা এবং অন্যান্য…’, তখন অনেক কিছু ভাববার, করবার এবং দেখবার সুযোগ তৈরি হয়। এমনকি দর্শক প্রত্যাশাও প্রবল, স্বতন্ত্র ও বিচিত্রমুখী হয়ে ওঠে। যদি শুধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রাজা’ হতো, তাহলে বহু প্রশ্ন এসে প্রাচ্যনাটের পরিবেশনাকে বিবর্ণ করে দিতে পারতো। ‘রাজা এবং অন্যান্য…’ নাটকে পরিবেশিত নৃত্যগুলো যথেষ্ট শিল্পমান সম্পন্ন। বসন্ত প্রকৃতির বৈচিত্র্য, প্রকৃতিজাত হৃদয়জ আনন্দ এবং চিরায়ত অনুরাগ প্রকাশে নৃত্যগুলো বিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। তবে পরিবেশিত ভারতীয় নৃত্যের সাথে পাশ্চাত্য ব্যালের সংমিশ্রণ কখনো কখনো অসংগত বলে মনে হয়। মনে হয় দর্শকপ্রিয়তার আকাক্সক্ষায় ধনবাদী কায়দায় লোভ ও লাভের মোহ সৃষ্টির কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। এ নাটকের কোরিওগ্রাফি আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দন। পরিবেশ সৃজনে নৃত্য ও কোরিওগ্রাফির সহায়ক ভূমিকা প্রশংসার দাবি রাখে। পোশাক ও সঙ্গীত সহায়তাও নাটকটিকে মানোত্তীর্ণ হতে সহায়তা করেছে।

 

এ নাটকের মঞ্চ পরিকল্পনায় প্রধানত দুটি পরিবেশ উপাস্থাপিত হয়েছে। এক. অন্ধকার ঘর, দুই. বসন্ত প্রকৃতি। অন্ধকার ঘরের জন্য মূল মঞ্চ এবং একটি সিঁড়ি। আর বসন্ত প্রকৃতির জন্য বর্ধিত মঞ্চ। এই সাধারণ মঞ্চ পরিকল্পনায় অসাধারণভাবে পরিবেশিত হয়েছে অন্ধকার ঘরের ভংয়করতা এবং আলোক-মধুর প্রকৃতির রমনীয়তা। ঘরের দৃশ্যে অরূপ রাজা একক এবং বাইরে বিচিত্র। তবে এই বাইরের দৃশ্যাবলিতে তিনি অরূপ হলেও রূপের লীলায় প্রকাশিত। এই রূপময়তার প্রকাশে পর্যাপ্ত সহায়তা দিয়েছে আলোক প্রক্ষেপন ও কুশীলবগণ। প্রায় সকল কুশীলবের মান উত্তীর্ণ অভিনয় সহৃদয়জনের প্রশংসা পায়। বিশেষ করে রানী সুদর্শনা, কাঞ্চীরাজ, সুরঙ্গমা, ঠাকুর দা, রোহিনী, কোশলরাজ, অবন্তীরাজ, ভদ্রসেন, কান্যকুব্জরাজ প্রমুখ।

 

এই যে রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা’ নাটকের নবতর নাট্যশৈলীময় উপস্থাপনা, নবীন ব্যাখ্যা ও অরূপের রূপময় প্রকাশ তা ঢাকার মঞ্চে নিঃসন্দেহে এক অভিনব ও নতুন পথ রচনার সূচনা। এ নিয়ে প্রশ্ন ও বিতর্ক থাকাটাই স্বাভাবিক। কারণ নাটকের ইতিহাসে বরাবরই নতুনের সূচনা হয়েছে বিতর্কের মধ্য দিয়ে। তাই দেখা যায় উনিশ শতকে বাংলার মঞ্চে অভিনীত নতুন ধারার নাটকগুলো প্রাথমিক অবস্থায় প্রাপ্য প্রশংসা লাভ করতো না। সে সময়ে নতুনের আগমনকে স্বাগত না জানিয়ে বিদ্রæপাতœক গান রচিত হয়েছিল। তারা উপহাস করে গাইত-

 

আমায় ফিরিয়ে দে না আধুলি

কি ঠকানটা ঠকালি।

 

২.১২.১৮৭৬ এবং ১০.০১.১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে ভুবনমোহন নির্দেশিত নতুন ধারার গীতিনাট্য ‘পারিজাত হরণ’ এর অভিনয় দেখে গিরিশচন্দ্র ঘোষ গানটি রচনা করেছিলেন। প্রাচীনপন্থী নাট্যজনেরা এই নবতর নাট্যশৈলীকে উদারভাবে গ্রহণ করতে পারেন নি। কিন্তু সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর আজ গীতিনাট্য নাট্যধারায় বিশিষ্ট স্থান অধিকরা করেছে। ‘রাজা এবং অন্যান্য…’ নাটকের ক্ষেত্রে তেমনটি হলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।

 

প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তিগত বিবেচনায় আজাদ আবুল কালাম ব্যাখ্যাত ও নির্দেশিত প্রাচ্যানাট প্রযোজিত ‘রাজা এবং অন্যান্য…’ নির্মাণে যে আত্মবঞ্চনামুক্ত ও অন্য নৈর্ব্যক্তিক নবীনতা লক্ষ্য করা গেছে তা বাংলাদেশের থিয়েটারের জন্য সম্পদ হয়ে থাকবে। এ সম্পদ অমূল্য। এ সম্পদ অলয়।

 

রতন সিদ্দিকী : নাট্যকলা শিক্ষক ও নাট্যকার