কইন্যা নাটকটি যারা দেখেছেন, ধারণা করি, আমার মতো তারাও নাটক শুরু হওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে বড় বড় দুটো ধাক্কা খেয়েছেন। প্রথমটি ভাষা নিয়ে। যে সংলাপগুচ্ছ দিয়ে নাটকটি শুরু হয়, সেগুলো বৃহত্তর সিলেটের (সম্ভবত হবিগঞ্জের)  আঞ্চলিক ভাষায় রচিত- যারা ওই অঞ্চলের মানুষ নন তাদের জন্য এই ভাষা রীতিমতো দুর্বোধ্য। এরকম দুর্বোধ্য ভাষায় রচিত নাটকটি শেষ পর্যন্ত দেখে ওঠা সম্ভব হবে কী না, হলেও আদৌ কিছু বুঝে ওঠা যাবে কী না সেটি যে কোনো দর্শকেরই মনে হতে বাধ্য। উদাহরণ হিসেবে নাটকের প্রথম সংলাপটিই তুলে দেয়া যাক।

কইন্যা পীরের মৃত্যু-প্রস্তুতি চলছে, তাঁর ভক্ত-আশেকানদের হাহাকার-আহাজারি-আর্তনাদের পরিপ্রেক্ষিতে-

কইন্যা পীর  কাইন্দোইন না। কাইন্দোইন না। ইটা একটা উৎসব। আমারে পাইবায় তোমরা জোড়া শিমুলোর আগাত। আমারে পাইবায় হরি লুটিপাখির লেঙ্গুড়ো। আমি থাকমু গুপাটো গরুর ক্ষুরোর লগে ওড়া ধুইল্লো, ১৪ বচরোর কাউরোর নাকোত জমা ঘাম। আমারে দেইকখো বরীর ফৎনার উফরে বওয়া ফড়িঙ্গোর লগে। আমারে হুইন্নো বাইচ্চর কোমোরোর তাগার লগোর ঘণ্টার আওয়াজো।

Koinya

প্রিয় পাঠক, পড়েও বুঝে ওঠা কঠিন মনে হচ্ছে না? তো, এরকম একটি সংলাপ যদি নাটকের শুরুতেই উচ্চারিত হয় তাহলে একটা ধাক্কা কি খেতে হয় না? অন্তত আমাদের মতো ‘নাগরিক দর্শক’দের জন্য- যারা সাধারণত প্রমিত-ভাষায় রচিত নাটক দেখতে অভ্যস্ত, কোনো নাটকে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার হলেও সেখানে ‘মডিফিকেশনের’ প্রলেপ পড়ে যাদের কাছে বোধগম্য করার দায়ে!

যাহোক, দ্বিতীয় ধাক্কাটিও খেতে হয় ওই প্রথম দৃশ্যেই। ‘কইন্যা পীরের’ মৃত্যু-প্রস্তুতির (স্বেচ্ছমৃত্যু, বলাই বাহুল্য, নইলে মৃত্যুর জন্য অমন আনুষ্ঠানিক প্রস্তুতি তো অসম্ভব!) এই দৃশ্যে পীর তার অনুগত বহুরূপীর সঙ্গে ‘মিলিত’ হন। বলা প্রয়োজন, এই মিলন সম-লিঙ্গের দুজন মানুষের মধ্যে সাধিত হয়। অর্থাৎ সমকাম। সমকাম? মঞ্চে! ঢাকার মঞ্চে!! দর্শকদের জন্য এই ধাক্কা সামলে ওঠাই তো কঠিন। কিন্তু শুধু সামলে ওঠা নয়, পুরো নাটকটিই দর্শকদেরকে বসে দেখতে বাধ্য করেন এর কলাকুশলীরা, তাঁদের অনবদ্য অভিনয়-নৃত্য-গীত আর কাহিনীর অভিনবত্ব দিয়ে। নাটকটি প্রথমবার দেখে এর অন্তত সত্তরভাগ সংলাপই আমি বুঝতে পারি নি- অজানা বিদেশী ভাষার নাটক-সিনেমা দেখে যেমন অনেকখানি আন্দাজে বুঝে নিতে হয়, প্রথম দেখায় আমার তেমনটিই ঘটেছে। কিন্তু এর অভিনবত্ব আমাকে দ্বিতীয়বার দেখতে প্ররোচিত করেছে। দ্বিতীয়বার অবশ্য ভাষাটি অতোটা দুর্বোধ্য লাগে নি, বরং প্রথমবারের অনেক চোখ-এড়িয়ে-যাওয়া দৃশ্য-ঘটনা-সংলাপ-ইঙ্গিত-প্রতীক দ্বিতীয় দেখায় পরিষ্কার হয়ে এসেছে।

২.

আগেই বলেছি এই নাটকের কাহিনীতে অভিনবত্ব আছে। আমাদের লোকায়ত ধর্মচর্চা আর একটি গ্রামীণ জনপদের মানুষদের বিশ্বাস, সংস্কার, আধ্যাতিœকতার প্রসঙ্গ এবং আনুষ্ঠানিক ধর্মশিক্ষায় শিক্ষিত মানুষদের ধর্মচর্চার সঙ্গে লোকায়ত ধর্মচর্চার বিরোধের প্রসঙ্গ (সম্ভবত) এই প্রথম আমাদের মঞ্চে রূপায়িত হলো। নাটকটির ব্রোশিউর থেকে কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি-

‘কালারুকা’ নামের জনপদের মানুষ মনে করে ‘কইন্যাপীর’ তাদের দেখে রাখেন। কইন্যাপীর এসেছিলেন সেই কবে এই কালারুকায়; গত হয়েছেন তাও যুগ যুগ আগে, তবু এমত বিশ্বাস বর্তমান, তার সাথী ‘বহুরূপী’কে তিনি রেখে যান খালি বাড়ির এক পুকুরে মাছ রূপে।

খালি বাড়িতে এখন থাকেন নাইওর ও দিলবর দুই ভাই। জনপদের সবাই জানেন, বিপতœীক নাইওরের ওপর কইন্যাপীরের ভর আছে। ইশকে মাতোয়ারা নাইওর ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলেন বহুরূপীর সাথে, যেন বহুরূপীর কাছে নিজেকে জানার দীক্ষা নেন।

Koinya

 

নাটকের কাহিনী আবর্তিত হয়েছে এই নাইওর আলীকে কেন্দ্র্র করেই। তিনিই এখন পীরের মর্যাদায় অভিষিক্ত। চার গাঁয়ের মানুষ তাঁকে মানে। তাঁর ধর্মচর্চা আনুষ্ঠানিকতা বর্জিত। অর্থাৎ নামাজ-রোজার মতো আনুষ্ঠানিক ধর্মচর্চা তিনি করেন না। গানবাজনা, নৃত্যগীত, গাঁজা, সিদ্ধি সবই চলে। চলে নৌকা বাইচ বা পাঁঠার লড়াইয়ের মতো লোক-আয়োজনও। কিন্তু এ সব কিছুর মধ্যে চলে তাঁর নিজেকে চেনার চেষ্টা। তাঁর এই চেষ্টা শেষ পর্যন্ত সফল হয় কী না সে প্রশ্ন আপাতত উহ্য রেখে তাঁর ও তাঁর অনুসারীদের সঙ্গে প্রথাগত শিক্ষিত মানুষের ধর্মচর্চার বিরোধ সম্পর্কে দু-একটা কথা বলা যাক। আগেই বলেছি নাইওর আলীর ধর্মচর্চায় ধর্ম-নির্দেশিত আনুষ্ঠানিকতার কোনো বালাই নেই। অন্যদিকে এই নাটকের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ‘সাহেবজাদা’ ও তার পিতার ধর্মচর্চা সম্পূর্ণভাবেই ধর্ম-নির্দেশিত। তারাও পীরের মর্যাদায় অভিষিক্ত, তবে তাদের ‘তরিকা’ আলাদা। নাটকের কোথাও অবশ্য এই তরিকার বিষয়টি পরিষ্কার করা হয় নি, কিন্তু আমরা জানি- বাংলাদেশে, বিশেষ করে ইসলাম ধর্মের চর্চায় নানা মত ও পথের অস্তিত্ব বিদ্যমান। একদল পীরপ্রথাকেই অবৈধ মনে করে। আবার যারা পীর প্রথায় বিশ্বাস করেন, তাদের মধ্যেও নানা মত ও পথ, এই মত ও পথের নামই তরিকা। কেউ শরিয়তপন্থী- এঁরা ইসলাম নির্দেশিত নানাবিধ আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে ও করাতে বদ্ধপরিকর, কেউ মারেফতপন্থী, যারা এইসব আনুষ্ঠানিকতাকে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন না। তাদের কাছে বেহেশত লাভের চেয়ে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভই শেষ কথা, আর সেটা পাবার জন্য নানা পদ্ধতি তাঁরা নিজেরাই তৈরি করে নেন। ভিন্ন ভিন্ন মতালম্বীদের মধ্যে দ্ব›দ্বও হয়, এবং সেই দ্ব›েদ্বর ইতিহাসও নতুন নয়, বহুকাল ধরে চলে আসছে। স্মরণযোগ্য যে, লালন ও তাঁর অনুসারীদেরকেও শরীয়তপন্থীদের নির্মম অত্যাচার সইতে হয়েছে একসময় (কাজী নজরুলকেও তো কাফের বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন শরীয়তপন্থী আলেমরা, সেটাই বা ভুলে যাবো কেন?)। এই দ্ব›েদ্বর একটি চিত্র পাওয়া যায় এই নাটকে। সাহেবজাদা মনে করেন নাইওর আলীর কর্মকাণ্ড ধর্মের দৃষ্টিতে অবৈধ। বিচ্ছিন্নভাবে তার কিছু কথাবার্তা তুলে ধরলেই বোঝা যাবে-

সাহেবজাদা   …লেঙ্গুট পরা আর নাইচ গানতো ইবাদত না। বেদায়াতি কাম।… দ্বীনের কাম শুরু করেন, আসল কাম। গান দিয়া কিতা আল্লার দিদার লাব হয়? আপনেওই কন? আপনে কিতা কইবেন? আল্লা দায়িত্ত¡ দিছইন এই সব অশিক্ষিত বে বুঝদার গো লগে কাম করার। নসিব। … আল্লার হুকুমে আমি দ্বীন ইসলামের এলেম লইছি। এলেম দরকার সবক দরকার। …

শুধু তাই নয়, এইসব কাজ যারা করেন, সাহেবজাদা তাদেরকে মুসলমান বলেই মনে করেন না, তার ভাষায় ওরা ‘মালাউন’।

কিংবা নৌকা-বাইচ বন্ধ করা বিষয়ে সাহেবজাদার কাছ থেকে ‘সবক’ নেয়া মেছাবের দু-একটি সংলাপও এই দ্ব›দ্বটিকে বুঝিয়ে দেবে-

মেছাব বাইচটা এক্কেবারে বন্ধ করইন। চামার কর্মকার কারিগর সবাই মিল্যা মচ্ছব বইয়াবো। দরকারটা কিতা?…

নাইওর এইবার আমি নিজে যাইমু বাইচো। চামার কর্মকার কারিগর মিল্যাইতো আমরা।

মেছাব কামডা ঠিক করতাছেন না। মালাউন গো নিয়া ক্যামনে আমরা হইমু। আর আপনে বুলে পীর। সব বেদায়াতি কাম।

নাইওর আমার ইবাদত আমি জানি মেছাব। …

নাটকের শেষের দিকে এসে দুই তরিকার দুই পীরের মাত্র একবারই দেখা হয়। নাইওর আলী তাঁর মৃত্যুর দিনক্ষণ ঘোষণা করেন, আর তার আগেই এ বাড়িতে আসেন সাহেবজাদা। তাদের সংলাপ-

সাহেবজাদা   …আপনে এক খাটি মুসলমানের বাইচ্চা। চাইর গাওয়ের মানুষ মানে আপনারে। মরতে চান কেরে আপনে। ইসলামে নিজে নিজে মইরা যাওন গুনা। কঠিন গুনার কাজ। জানাজাও অয় না। আত বাড়াইন নিজর থ্যাইকা। আইন দ্বীনের কাম করি। ইবাদত করি।

নাইওর উপরে থাইকন আপনে। জমি ছুইবাইন না। আমার ইবাদত আমি জানি। আমার ইবাদত ক্বলব থেইক্যা। দিদার চাই তার। খোদায়ী ইশক। আইজ রাইত এই তলানীতে হাইট্টা যাইমু আমি। খোদায়ী ইশক। খবরদার মাটি ছুইবেন না। এই দেখইন সবুজ পানির নিচে বহুরূপী ইশারা করইন আমারে।

ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার কিংবা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করার প্রসঙ্গটি আমাদের শিল্পসাহিত্যের নানা মাধ্যমে বারবার উঠে এসেছে, মঞ্চেও এসেছে, কিন্তু ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের মধ্যেই যে ধর্মচর্চার ধরন নিয়ে একটি দ্বন্দ্ব ও বিতর্ক জোরেশোরে চালু আছে সেই বিষয়টি সম্ভবত এই প্রথম একটি মঞ্চ নাটকে নিয়ে আসা হলো। (এটা ইরাক বা পাকিস্তানের শিয়া-সুন্নী বিরোধের মতো ব্যাপার নয়, বরং সুন্নীদের মধ্যেই আছে বহু উপবিভাগ, তাদের মধ্যে বিরোধও প্রবল। টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেলে ইসলামিক অনুষ্ঠানগুলো দেখলেই সেই দ্বন্দ্বটি বোঝা যায়। একই বিষয় – যেমন মিলাদ/কিয়াম,  কবর/মাজার জিয়ারত, শবেবরাত ইত্যাদি- নিয়ে দুই চ্যানেলে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর ব্যাখ্যা-বক্তব্য দেয়া হয় কোরআন-হাদিসের রেফারেন্স টেনেই। কোনটি যে সত্য তা নির্ণয় করা সাধারণ মানুষের পক্ষে নিতান্তই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। শুধু তাই নয়, তারা পরস্পরকে বকাবাজি-গালাগালি করতেও পিছপা হন না। কিন্তু নাইওর আলী-সাহেবজাদার মধ্যে যে  দ্বন্দ্ব সেটি এই টেলিভিশনজীবীদের দ্বন্দ্ব থেকে আলাদা

তাছাড়া, নাটকে ধর্মচর্চা করেন এমন ব্যক্তিরা সাধারণত উপস্থাপিত হন প্রায় হাস্যকরভাবে, যেন তাদেরকে নিয়ে কেবল হাসি-ঠাট্টা-ব্যঙ্গ-বিদ্রুপই করা চলে- অন্য কিছু নয়। এই নাটকে সেটি করা হয় নি। দ্বন্দ্বটি দেখানো হয়েছে বটে কিন্তু কারো প্রতি বিশেষ কোনো পক্ষপাত প্রদর্শন করা হয় নি, কাউকে আঘাত করার চেষ্টাও করা হয় নি। বিষয়টিকে এভাবে মঞ্চে নিয়ে আসার জন্য নাট্যকার এবং নির্দেশক বিশেষভাবে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন পাবার অধিকার রাখেন।

৩.
কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থেকে যায় যে, নাইওর আলীর এই বিশ্বাস ও চর্চার উৎস কোথায়? ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী তিনি, তা তো বোঝাই যায়, কিন্তু তিনি যা যা করেন সেসব কি ইসলাম সমর্থন করে? আরবে উদ্ভাবিত ইসলামে নৌকা বাইচ, পাঁঠার লড়াই, নৃত্য-গীত, বাদ্য-বাজনার কোনো স্থানই নেই। থাকার প্রশ্নও ওঠে না। কিন্তু নাইওর আলীর ধর্মচর্চায় এগুলো প্রবলভাবে উপস্থিত। কীভাবে এই বিষয়টির ব্যাখ্য করা সম্ভব? কীভাবেই বা আমাদের লোকায়ত ধর্মচর্চায় ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার বদলে জায়গা করে নিলো এইসব বিষয়

Koinya

বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে হলে আমাদেরকে একটু পেছনে ফিরে তাকাতে হবে। প্রয়োজন হয়ে পড়বে ইসলামের ইতিহাস নিয়ে কথা বলার। আমি যে ইতিহাসের কথা বলছি সেটা রাজা বাদশাহদের ইতিহাস নয়- জনগণের ইতিহাস। মুশকিল হলো জনগণের ইতিহাস সবসময় অলিখিতই থেকে যায়- লিখিত ইতিহাসে জনগণ থাকে বরাবরই উপেক্ষিত। ইতিহাস মানেই যেন রাজ-রাজড়াদের ব্যাপার, জনগণের যেন কোনো ভূমিকাই ছিলো না ইতিহাসের কোনো পর্বে, কোনো ঘটনায়। যাহোক, প্রথমেই যা বলা দরকার তা হলো- বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে ইসলাম গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে মূলত সুফি-সাধক ধর্মপ্রচারকদের কারণে, শাসক শ্রেণীর জন্য নয়। শাসকদের ধর্ম দেখে যারা ধর্ম পরিবর্তন করে তারা আর যাই হোক সাধারণ জনগণ নয়, উচ্চশ্রেণীর সুবিধাবাদী লোকজন। শাসকদের কাছ থেকে সুদৃষ্টি পাওয়ার আশায় কেউ কেউ ধর্ম পরিবর্তন করলেও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর তাতে কিছুই যায় আসে না। এই সুফি সাধকদের অনাড়ম্বর জীবনযাপন, মানুষের মন বুঝে কাজ করা ও কথা বলার ক্ষমতা, জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান দার্শনিক হওয়া সত্ত্বেও নিরহংকারী সন্তের মতো সাধারণ মানুষদের দুঃখ-দুর্দশা-সংকট-সমস্যার সঙ্গী হতে পারার সহজাত প্রবণতা এ অঞ্চলের মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিলো। এ অঞ্চলের মানুষ যে ইসলাম আগমনেরও বহু আগে থেকেই শান্তিপ্রিয় ছিলো সেটা বৌদ্ধধর্মের জনপ্রিয়তা দেখেও বোঝা যায়- ইসলামের আগে বৌদ্ধধর্মেও শান্তি ও সম্প্রীতির কথা বলা হয়েছিলো।  লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে- সুফিরা যে ইসলাম নিয়ে এসেছিলেন তা আরবে উদ্ভাবিত মূল ইসলাম নয়, বরং দার্শনিকভাবে অনেকখানি পরিবর্তিত ও আচারসর্বস্বতা-বর্জিত ইসলাম। সুফিবাদের জন্ম মূলত পারস্যে, মূল ইসলাম ওখানে গিয়ে অনেকখানি পরিবর্তিত হয়ে যায়; আবার এই সুফিরা যখন ভারতবর্ষে এলেন সেই সুফিবাদেরও খানিকটা পরিবর্তন সাধন করতে হলো। কোনো দর্শনই যে দেশকালের পরিপ্রেক্ষিতে তার অবিকৃত রূপ ধরে রাখতে পারে না- এই প্রগতিশীল ধারণাটি সুফিদের মধ্যে ছিলো; তাই তাঁরা ভারতবর্ষে এসে এই জনগোষ্ঠীর মন বুঝতে চেষ্টা করলেন। এবং আবিষ্কার করলেন- এই জনগোষ্ঠীর কাছে ইসলামকে গ্রহণযোগ্য করতে হলে প্রেমের কথা বলতে হবে, ভক্তির কথা বলতে হবে- কারণ এ অঞ্চলে দুটোরই জয়জয়াকার। অতএব সুফিবাদ নিজেকে খানিকটা বদলে নিলো- মানুষের কাছে তারা বলতে লাগলেন প্রেমের কথা, বোঝাতে লাগলেন স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির সম্পর্ক দ্বন্দ্বের নয়, প্রেমের। একমাত্র প্রেমের মাধ্যমেই পাওয়া যাবে স্রষ্টাকে- অন্য কোনোভাবে নয়। প্রেম ও ভক্তির এই কথাগুলো এ অঞ্চলের মানুষের কাছে আগে থেকেই পরিচিত ছিলো- তার সঙ্গে যুক্ত হলো মানুষে-মানুষে সমতার কথা, ভ্রাতৃত্বের কথা, সমান অধিকারের কথা, শান্তি ও সম্প্রীতির কথা। তরবারী দিয়ে নয়, কঠোর ধর্মীয় আচারসর্বস্বতা দিয়ে নয়, ভয়-ভীতি-হুংকার দিয়েও নয়- স্রেফ শান্তি-সম্প্রীতি-মানবতা-সাম্য-প্রেম-ভক্তি-ভ্রাতৃত্ব ইত্যাদির কথা বলে সুফিরা জয় করে ফেললেন একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে।

কিন্তু সুফীরা যে ইসলাম নিয়ে বাংলাদেশে এসছিলেন আমাদের লোকায়ত ইসলাম তো তার থেকেও আলাদা। এর ব্যাখ্যা কি? এসব বিষয়ে লেখালেখি অনেক হয়েছে, আমি দু-একটির প্রসঙ্গ উত্থাপন করবো। ৪০-দশকের গোড়ার দিকে (এপ্রিল, ১৯৪১) বিনয়কুমার সরকার ‘বেঙ্গলি কালচার অ্যাজ এ সিস্টেম অব মিউচ্যুয়াল আককুলটুরেশনস’ শিরোনামে যে প্রবন্ধটি লিখেছিলেন, সেটিতে তিনি বাঙালির সংস্কৃতি সম্বন্ধে এক গভীর ও সুদুরপ্রসারী প্রসঙ্গের অবতারণা করেন। ১৯৪২ সালে এই লেখাটির বাংলা অনুবাদ করেন ক্ষিতি মুখোপাধ্যায়। শুধু অনুবাদই নয়, রচনাটির অনুপঙ্খু বিশ্লেষণও হাজির করেন তিনি। এই লেখা ও এর বিশ্লেষণের মূল কথটি হলো সংস্কৃতির বিনিময়। আককুলটুরেশনস কথাটির ব্যাখ্যা এরকম-

কোনো সংস্কৃতি অন্য সংস্কৃতির ভিতর প্রবেশ করিতে থাকিলে দ্বিতীয় সংস্কৃতিটার অল্পবিস্তর অথবা বেশকিছু রদবদল ঘটিতে থাকে। এই দুই সংস্কৃতি হইতে সংস্কৃতির নতুন গড়ন বা ছাঁচ গড়িয়া ওঠে।…দুই সংস্কৃতির মেলামেশার প্রণালীকেই আককুলটুরেশনস বলা যায়।…আর মিউচ্যুয়াল আককুলটুরেশনস মানে পারস্পরিক সংস্কৃতি-বিনিময়, বা সংস্কৃতির লেনদেন। [সূত্র : বাঙলায় দেশী-বিদেশী (বঙ্গ-সংস্কৃতির লেন-দেন), বিনয় সরকার, ১৯৪২]

Koinya

তাঁরা দেখালেন, আদি বাঙালির সংস্কৃতির সঙ্গে অন্য সংস্কৃতির বিনিময়ের ফলে নতুন সংস্কৃতির ধরন কীভাবে পাল্টে গেলো। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে দিকটার প্রতি তাঁরা দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন, সেটি হলো বাংলায় বিভিন্ন ধর্মের প্রবেশ এবং এর প্রভাবে বাঙালি সংস্কৃতির রূপান্তর, একইভাবে বাঙালি সংস্কৃতির প্রভাবে বাইরে থেকে আসা ধর্মগুলোর রূপান্তর। তাঁদের মতে- শুধু ইসলামই নয়, হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মও বাংলা অঞ্চলের বিদেশী ধর্ম। এইসব ধর্মের আগমনের আগেও এ অঞ্চলের মানুষের নিজস্ব কোনো ধর্ম ছিলো- তাঁরা এর নাম দিয়েছেন বাঙালি ধর্ম। তাঁরা এ-ও বললেন-  ইসলাম আসার আগে এ অঞ্চলের সমস্ত মানুষ হিন্দু বা বৌদ্ধ ছিলো- ঐতিহাসিক এই ধারণাটিই ভুল। বরং এক বিরাট সংখ্যক জনগোষ্ঠী অ-হিন্দু বা অ-বৌদ্ধ রয়ে গিয়েছিলো, বা কেউ কেউ সেসব ধর্ম গ্রহণ করলেও তা এমনভাবে তাঁদের আদি সংস্কৃরি ছাঁচে ঢেলে পরিবর্তিত করে নিয়েছিলো যে তাদেরকে বড়জোর নিম-হিন্দু বা নিম-বৌদ্ধ বলা যায়। ইসলাম আগমনের ফলে এই অঞ্চলের অ-হিন্দু বা অ-বৌদ্ধ এক বিরাট সংখ্যক লোক, সঙ্গে কিছ’ হিন্দু এবং কিছু বৌদ্ধও নতুন ধর্ম গ্রহণ করে। কিন্তু নিজস্ব সংস্কৃতিকে বিসর্জন দেয়া এ ক্ষেত্রেও ঘটে নি। ফলে প্রত্যেক ধর্মই বাঙালি ধর্মের দাপটে নিজেদের আদি রূপ খুইয়ে নতুন এক রূপ লাভ করে। এ বিষয়ে তাঁদের মত-

বাঙালী হিন্দুরা পরধর্মে দীক্ষাপ্রাপ্ত কনভার্ট মাত্র। ইংরেজ খৃষ্টিয়ানরা, মিশরের মুসলমানরা, ইরানের মুসলমানরা যেমন পরধর্মে দীক্ষিত, বাঙালীরাও অবিকল তাই।…হিন্দু সংস্কৃতি ও হিন্দুধর্ম সেকালের বাঙলার ‘অনার্য’ নর-নারীর পক্ষে বিদেশী জিনিস। কিন্তু বাঙালী জাত এই বিদেশী ধর্ম ও সংস্কৃতিকে নিজ ধর্ম ও সংস্কৃতির বশে আনিয়াছিল। তথাকথিত আর্যধর্ম ও সংস্কৃতি অনার্য সংস্কৃতির প্রভাবে পড়িয়া অনার্যীকৃত হইয়াছে। ইহাকে বলিব অবাঙালী সংস্কৃতির বাঙালীকরণ। হিন্দুধর্ম বা বৌদ্ধধর্ম অনায়াসে বাঙালীদের জয় করিয়া লইতে পারে নাই। বাঙালী ধর্মের নিকটও ইহাদের মাথা নোয়াইতে হইয়াছে।…আর্যধর্ম যেমন বাঙলাদেশকে জয় করিয়াছে, বাঙালী ধর্ম-ও তেমনি ইহাকে নাজেহাল করিয়াছে। জয়টা এক তরফা হয় নাই- ধর্মান্তর বা মতান্তর গ্রহণটা হইয়াছে পারস্পরিক। বাঙলাদেশে খুব বেশী লোককে পরধর্ম (হিন্দুত্ব) স্বীকার করানো সম্ভব হয় নাই। অসংখ্য নরনারী অহিন্দু, অর্থাৎ বাঙালী বা অনার্য রহিয়া গিয়াছিল।…বাঙালীর সৃষ্টিশক্তি ইসলামকেও সহজে পথ ছাড়িয়া দেয় নাই। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের মতো ইসলামকেও বাঙালীদের নিকট পরাজয় স্বীকার করিতে হইয়াছে। এই সকল ক্ষেত্রে ধর্মের সঙ্গে সংস্কৃতিকেও বুঝিয়া রাখিতে হইবে।…বিদেশী সংস্কৃতিগুলোর উপর স্বদেশী সংস্কৃতির প্রভাব গভীরভাবে লক্ষ্য করিবার বিষয়। [সূত্র : বাঙলায় দেশী-বিদেশী (বঙ্গ-সংস্কৃতির লেন-দেন), বিনয় সরকার, ১৯৪২

এর ফল কী রকম সুদূর প্রসারী হয়েছিলো তার প্রমাণ হিসেবে বলছেন-

বাঙালী হিন্দু ও বাঙালী মুসলমানদের আচার-ব্যবহার ও চালচলনে মিল আছে। কারণ কি? সাধারণের ধারণা- হিন্দুদের কেহ কেহ মুসলমান হইয়া যাওয়ায় এইরূপ ঘটিয়াছে। কথাটার ভিতর কিছু সত্য আছে। কিন্তু আসল কারণ- হিন্দু ধর্মের মতো মুসলমান ধর্মেও অনার্য বাঙালী আদিম লোকদের আচার-ব্যবহার আর চালচলন ঢুকিয়া গিয়াছে। হিন্দু ও মুসলমান দুই ধর্মেই ‘বাঙ্লামি’র প্রলেপ পড়িয়াছে। হিন্দু ও মুসলমান ধর্মের উপর খাঁটি স্বদেশী সংস্কৃতি দিগবিজয় চালাইতেছে। এই কথাটা মনে রাখিলে বাঙালী হিন্দু এবং মুসলমানদের রীতিনীতির ভিতর ঐক্য ও সাদৃশ্যগুলো সহজে বুঝিতে পারিব। দুই সংস্কৃতিই ‘বাঙালীকরণের’ প্রভাবে অনেকটা একরূপ দেখাইয়া থাকে। [সূত্র : বাঙলায় দেশী-বিদেশী (বঙ্গ-সংস্কৃতির লেন-দেন), বিনয় সরকার, ১৯৪২]

অর্থাৎ বিভিন্ন ধর্মের আগমনে আদি বাঙালি সংস্কৃতি তার রূপ পরিবর্তন করেছে বটে, কিন্তু এই সংস্কৃতি এতটাই শক্তিশালী এবং আধিপত্যবিস্তারী ছিলো যে প্রবল পরাক্রমশালী হিন্দুধর্ম বা ইসলাম ধর্মও তাদের নিজেদের ‘আদি’ রূপ ধরে রাখতে পারে নি, বরং আদি বাঙালি সংস্কৃতির প্রভাবে দুটো বিপরীত মেরুর ধর্ম কখনো কখনো একইরূপ প্রদর্শন করতে বাধ্য হয়েছে, এখনও হচ্ছে। লেনদেন হয়েছে বটে, তবে বাঙালি সংস্কৃতি পরাজয় স্বীকার করেনি।

এই নাটকের নাইওর আলীর ধর্মচর্চায় আসলে সেই চিরায়ত বাঙালির পরিচয় পাওয়া যায়।

আরেকটি উদ্ধৃতি দিয়ে এ প্রসঙ্গ শেষ করবো। আবু জাফর শামসুদ্দীন তাঁর লোকায়ত সমাজ ও বাঙালী সংস্কৃতি গ্রন্থভুক্ত বাঙালীর সমন্বিত লোক সংস্কৃতি প্রবন্ধে লিখেছেন –

হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে এখনও বাংলাভাষাভাষী অঞ্চলের গান বাজনা তাল সুর লয় এবং নৃত্য ও বাদ্যযন্ত্র অভিন্ন। নির্দিষ্ট কয়েকটি ধর্মানুষ্ঠান এবং মৃত্রে সৎকার প্রভৃতি ব্যতিরেকে বাকী সকল প্রকার আনন্দোৎসব মেলা প্রভৃতিতে সকলে একত্রিত হয়। লাঠি খেলা, তরবারি ও রামদার খেলা, হাডুডু ও দাইড়া খেলা প্রভৃতি সকল ধর্মাবলম্বী মানুষের ক্রীড়া। বাসগৃহের নির্মাণ কৌশল ভিতরের আসবাব, নকশি কাথা, শয্যা, তৈজসপত্র, কৃষি যন্ত্রপাতি, অস্ত্র-শস্ত্র সবকিছু অভিন্ন। এ মাঠের জমিতে সকলে পাশাপাশি চাষ করে এবং একই ফসল ফলায়। উৎপাদন পদ্ধতিও অভিন্ন। ধর্মীয় বিধানে বিশেষভাবে নিষিদ্ধ কয়েকটি দ্রব্য ব্যতিরেকে ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল বাঙালীর খাদ্য তালিকা ও পাক প্রণালী অভিন্ন।…সকল বাঙালী পল্লীবাসীর পোশাক পরিচ্ছদ অলংকারপত্র প্রসাধন দ্রব্য প্রভৃতি আগেও অভিন্ন ছিল, কিঞ্চিত উন্নতির পর এখনও অভিন্ন আছে

বাঙালিত্বের এই রূপের প্রকাশ ঘটেছে কইন্যা নাটকের ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে দিয়ে।

৪.
শুধু ধর্মচর্চার ধরন নিয়ে দ্বন্দ্বের বিষয়টিই নয়, এই নাটকের আরও অনেককিছুই মঞ্চনাটকে নতুনত্বের স্বাদ এনেছে। যেমন, নাইওর আলী এবং কইন্যা চরিত্র দুটোকে মানুষ ছাড়াও অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে কথা বলতে দেখা  গেছে। নাইওর আলী পাঁঠার সঙ্গে কথা বলেন। শুধু কথা বলেন বললে ভুল হবে, তাঁর ভাষায়- ‘কারো লগে মাততে মন না চাইলে তর লগে মাতি। তুই বুঝস আমি কিতা কই, আমি বুঝি তুই কিতা মাতছ।’

অর্থাৎ তাঁর এবং পাঁঠার মধ্যে কথা বিনিময় হয়, দুজন দুজনের ভাষা বোঝেন। কইন্যাও মেঘের সঙ্গে কথা বলে, ঝিঙে ফুলের সঙ্গে কথা বলে। কথা বলে ব্যাঙ, ঘুঘু কিংবা মাছ- এ-সব কিছুর সঙ্গে। এখানেও ওই একই ব্যাপার। একতরফা কথা নয়, কথা বিনিময়। মেঘ বা ঝিঙে ফুল পর্যন্ত তার ডাকে সাড়া দেয়!

অর্থাৎ নাইওর আলী এবং কইন্যা যোগাযোগের ক্ষেত্রে অন্যান্য মানুষের চেয়ে কয়েক স্তর এগিয়ে আছে। তাদের যোগাযোগ শুধু মানুষের সঙ্গেই নয়, মনুষ্যাতীত আরও অনেক কিছুর সঙ্গে- যাদের সঙ্গে সাধারণত আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কখনো যোগাযোগ হয় না।

বিষয়টি একটু ব্যাখ্যার দাবি রাখে। মানুষ কি আসলে এমন কোনোকিছুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে যার মানুষের মতো ভাষা নেই? যেমন মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী বা উদ্ভিদ বা ফুল বা মেঘ-পাহাড়-সমুদ্র বা অন্য কোনো জড়পদার্থ? সাধারণ বিবেচনায় এটিকে অসম্ভব বলেই মনে হয়। কিন্তু ভারতীয় দর্শনের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, এখানে মনে করা হয়- মহাবিশ্বের সকল সৃষ্টি আসলে স্রষ্টারই ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ মাত্র। সকলেরই নিজস্ব ভাষা আছে, কারণ সবকিছুই একই উৎস থেকে সৃষ্ট। বৈজ্ঞানিকভাবে জগদীশ চন্দ্র বসুও এটি প্রমাণ করে দেখিয়েছেন- যে আঘাতে মানুষ যেভাবে সাড়া দেয়, উদ্ভিদ এমনকি জড়পদার্থও একইভাবে সাড়া দেয়, পার্থক্য শুধু এই যে মানুষ তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারে অন্যরা পারে না। ‘পারে না’ মানে কিন্তু এই নয় যে, তাদের ভাষা নেই। আছে, তবে আমরা তা বুঝতে পারি না। তাঁর ভাষায়-

গাছের প্রকৃত ইতিহাস সমুদ্ধার করিতে হইলে গাছের নিকটই যাইতে হইবে। সেই ইতিহাস অতি জটিল ও বহু রহস্যপূর্ণ। সেই ইতিহাস উদ্ধার করিতে হইলে বৃক্ষ ও যন্ত্রের সাহায্যে জন্ম হইতে মৃত্যু পর্যন্ত মুহূর্তে মুহূর্তে তাহার ক্রিয়াকলাপ লিপিবদ্ধ করিতে হইবে। এই লিপি বৃক্ষের স্বলিখিত এবং স্বাক্ষরিত হওয়া চাই। ইহাতে মানুষের কোনো হাত থাকিবে না; কারণ মানুষ তাহার স্বপ্রণোদিত ভাব দ্বারা অনেক সময় প্রতারিত হয়। [সূত্র: অব্যক্ত, জগদীশ চন্দ্র বসু]

অর্থাৎ গাছের ভাষা বুঝতে হলে গাছ-ই হতে হবে। নইলে ওই ভাষা বোঝা যাবে না। কোনো মানুষের পক্ষে যদি ওরকম একটি স্তরে পৌঁছানো সম্ভব হয় তাহলে তার পক্ষে তো দৃশ্যাতীত কোনো কিছুর সঙ্গেও যোগাযোগ সম্ভব হতে পারে! এই নাটকে অন্য কেউ যাকে দেখতেই পায় না, নাইওর আলী আর কইন্যা সেই বহুরূপীর সঙ্গে কথপোকথনে লিপ্ত হয়- সেটা কি সম্ভব এই কারণে যে, তারা যোগাযোগের অন্য স্তরে বাস করে?

এরকম বহু ইঙ্গিত, প্রশ্ন, প্রতীক ছড়িয়ে আছে নাটকের পরতে পরতে। যেমন, যৌনতার বিষয়টিকে খুব প্রকটভাবে দৃশ্যমান করা না হলেও ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে যে, এই বিষয়ে তারা প্রায় সহজিয়া মতবাদের অনুসারী। অর্থাৎ যৌনতা নিয়ে তাদের অহেতুক কোনো ট্যাবু নেই। নাইওরের ভাই দিলবরের সঙ্গে হিজড়ার সম্পর্ক নিয়ে তাই কেউ কোনো প্রশ্ন তোলে না, প্রশ্ন তোলে না নাইওরের সঙ্গে মস্তুরার সম্পর্ক নিয়েও। এমনকি কইন্যার সঙ্গেও এ বাড়ির একাধিক পুরুষের যৌন সম্পর্কের ইঙ্গিত রয়েছে এই নাটকে। ফলে কইন্যা যখন গর্ভবতী হয়, এই সন্তান কার এ নিয়ে একটি প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। এবং নাটকের শেষে গিয়েও এই প্রশ্নের উত্তর মেলে না

৫.
কিন্তু শুধু ‘গল্প’ দিয়ে মঞ্চ নাটককে টেনে নেয়া কঠিন, অসম্ভবই বলা যায়। শুধু মঞ্চ নাটক-ই বলি কেন, অনেক টিভি নাটকেও চমৎকার একটি গল্প থাকা সত্ত্বেও নানা কারণে তা মার খেয়ে যায়। মার খাওয়ার সেই ‘নানা কারণ’ যেন না ঘটে সেই কাজটি করেেত হয় নির্দেশককে। নাট্যকারের কাজ নাটক লেখা পর্যন্তই, সেটি দৃশ্যামন করে তোলার কাজটি নির্দেশকের। আবার নির্দেশক একা সব কাজ করে উঠতে পারেন না, তাঁকে নির্ভর করতে হয় অভিনেতৃ, সঙ্গীত নির্দেশক, আলোক পরিকল্পক, পোশাক পরিকল্পক এইরকম আরো অনেকের ওপর। আর সেজন্যই প্রশ্ন ওঠে যে, সব মিলিয়ে মঞ্চে আমরা যা দেখি তার সাফল্যের কৃতিত্ব বা ব্যর্থতার দায়ভার কার? মঞ্চ নাটক সম্বন্ধে এরকম একটি প্রশ্ন, আমার মতো আরও অনেক দর্শকেরই, আছে বলে ধারণা করি। এবং বলা যায় এ কথাই- মঞ্চ নাটক কারো একার সম্পত্তি নয়। নাট্যকার-নির্দেশক-অভিনেতৃ এবং অন্যান্য কলাকুশলীর যৌথ মালিকানায় থাকে একটি মঞ্চ নাটক।

Mandar

আগেও বলেছি, এই নাটকে ভাষাজনিত প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়েই ক্ষান্ত দেন না, বরং পুরো নাটকটিই দর্শকদেরকে বসে দেখতে বাধ্য করেন এর কলাকুশলীরা তাঁদের অনবদ্য অভিনয়-নৃত্য-গীত আর কাহিনীর অভিনবত্ব দিয়ে। পুরো নাটকের সামগ্রিক উপস্থাপনা এতো হৃদয়গ্রাহী যে, দর্শকদের মনেই থাকে না- এই ভাষাটি তার অজানা, সে অনেককিছুই বুঝতে পারছে না! ‘কবিতা বোঝার আগেই স্পর্শ করে’ এই বহুলকথিত বাক্যটি হয়তো সব শিল্পের জন্যই সত্যি, কারণ কইন্যা-ও বোঝার আগেই স্পর্শ করে। এর একটি প্রধান কারণ অভিনেতৃদের পারঙ্গমতা। তারা আগাগোড়া মঞ্চটিকে জমজমাট করে রেখেছেন। আমি বিস্ময়ের সঙ্গে ভেবেছি, এই অভিনেতৃদের সবাই নিশ্চয়ই সিলেট অঞ্চলের মানুষ নন, সেক্ষেত্রে প্রায় বিদেশী ভাষার মতো একটি ভাষাকে আয়ত্ত্ব করে আগাগোড়া একই গতিতে নাটককে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া তো রীতিমতো দুঃসাধ্য কাজ। তারা সেই কাজটি সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করেছেন, নাটকটিকে রেখেছেন প্রচণ্ড গতিশীল, কোথাও এতটুকু হেলে-ঝুলে পড়তে দেন নি। চোখে পড়ার মতো অভিনয় করেছেন শাহানা রহমান সুমি, রাহুল আনন্দ, ঋতু এ সাত্তার, শতাব্দী ওয়াদুদ এবং আজাদ আবুল কালাম। কইন্যার চরিত্রে সুমি অসাধারণ। চরিত্রটি নির্মাণই করা হয়েছে কোমল ও মায়াময় করে।  সেটিকে দৃশ্যমান করে তোলার জন্য সুমিকে সবসময়ই সংলাপ বলতে হয়েছে নিচু স্বরে, কণ্ঠ কখনোই উঁচুতে ওঠে নি। কাজটি কঠিন- যেহেতু শেষ সারির দর্শকের কাছেও নিজের স্বর পৌঁছে দেয়ার একটা দায় মঞ্চশিল্পীদের থাকে। তাছাড়া এই নাটকের প্রায় সব চরিত্রের কণ্ঠই উঁচু স্বরে বাঁধা, একা কইন্যাই শুধু নিচু সুরে কথা বলে যায়, যেন নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলছে, যেন সে এই পরিপার্শ্বের কেউ নয়! এমন একটি চরিত্রে স্বর এতটুকু উঁচু না করেও শেষ সারির দর্শকদের কাছে নিজের কথাটি পৌঁছে দিয়ে এবং মুহূর্তে মুহূর্তে পরিবর্তনশীল আনন্দ-বেদনা, উচ্ছ্বলতা-বিষণ্নতার মতো বিভিন্ন ধরনের এক্সপ্রেশন ফুটিয়ে তুলতে তুলতে সুমি যেভাবে নাটকের শেষ দৃশ্য পর্যন্ত অভিনয় করে গেলেন সেটি রীতিমতো বিস্ময়কর। অন্যদিকে ঋতুর চরিত্র ‘মস্তুরা’ স্বভাবে আচরণে কথাবার্তায় একবারে কইন্যার বিপরীত। কোমলে-কঠোরে মেশানো চরিত্র তার, কোমল রূপটি প্রায় সবসময়ই ঢেকে রাখেন, কিংবা কোমল অনুভূতিগুলোও প্রকাশ করেন উচ্চ স্বরে, তীব্রভাবে। প্রচণ্ড গতিময়তা আছে এই চরিত্রে, ঋতু যেন তার সমস্তসত্ত্বা দিয়ে সেই গতিকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। রাহুল আনন্দ দুটো চরিত্রে অভিনয় করেছেন- বহুরূপী ও ইশাদ। দুটো একেবারেই ভিন্ন মেজাজের, বলা যায় বিপরীত মেরুর, মুহূর্তের মধ্যে শুধুমাত্র পোশাক পরিবর্তন করে তিনি যেভাবে এই দুই চরিত্রের মধ্যে যাওয়া-আসা করলেন সেটি দেখে বোঝারই উপায় ছিলো না যে, একই ব্যক্তি এই দুটো চরিত্রে অভিনয় করছেন। চরিত্রের মধ্যে লীন হয়ে গেলেই হয়তো এই মধুর বিভ্রম তৈরি করা সম্ভব। দিলবর আলী চরিত্রে শতাব্দী ওয়াদুদও চমৎকার করেছেন, যদিও এই চরিত্রের আরেকটু বিকাশ নাট্যকার-নির্দেশক মিলে করতে পারতেন। দ্বন্দ্ববহুল একটি চরিত্র তার, শতাব্দী চেষ্টাও করেছেন, কিন্তু চরিত্রটি যতোখানি মনোযোগ পাবার অধিকার রাখে- নাট্যকার ও নির্দেশকের কাছে তা পায় নি বলেই মনে হয়েছে। একই কথা মেছাব চরিত্রটি সম্বন্ধেও। এই নাটকের সবচেয়ে দ্বন্দ্ববহুল চরিত্র এটি। দুই তরিকার দুই পীরের কাছেই সে দীক্ষা পেয়েছে, ফলে নিজের সঙ্গেই তার নিজের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। কিন্তু সেটিকে প্রধান না করে, বরং তার প্রভাব-বিস্তারের লোভকে প্রধান করে তোলাটা সুবিবেচনাপ্রসুত মনে হয় নি আমার কাছে। এই চরিত্রে তৌফিকুল ইসলাম ইমনও সেই চেষ্টা থেকে বিরত থেকেছেন বলে এটি একটি অপূর্ণ চরিত্র বলে মনে হতে পারে। নাইওর আলী চরিত্রে আজাদ আবুল কালামের অভিনয় সম্বন্ধে কিছূ বলার চেয়ে সামগ্রিকভাবেই বলি- ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, আমাদের মঞ্চে (বা টিভি নাটকে) হুমায়ূন ফরীদির পর এত বড় মাপের অভিনয়-প্রতিভা নিয়ে আর কেউ আসেন নি। এই নাটকেও তিনি তাঁর নামের প্রতি সুবিচার করেছেন।

অভিনয় ছাড়াও এই নাটকের আরেকটি বড় আকর্ষণ- এর সঙ্গীত পরিচালনা। নাটক দেখে বেরোনোর পর সঙ্গীত নির্দেশক রাহুল আনন্দের সঙ্গে দু-মিনিট কথা বলার লোভ সামলাতে পারি নি। জিজ্ঞেস করে জেনেছি, এই নাটকে ব্যবহৃত গানগুলোর মধ্যে একটি শাহ আবদুল করিমের লেখা, দুটো তাঁর নিজের আর বাদবাকিগুলো তাঁর মায়ের কাছ থেকে তিনি সংগ্রহ করেছেন। এই বাদবাকিগুলোর রচয়িতা বা সুরকার সম্বন্ধে কিছু জানার উপায় নেই, কারণ এই গীতগুলো যুগ যুগ ধরে আমাদের গ্রামাঞ্চলে গাওয়া হচ্ছে। কেউ খবর রাখে নি- কতোকাল আগে এগুলো রচিত বা সুরারোপিত হয়েছিলো, কে বা কারা সেগুলো করেছিলেন! আমাদের লোকসঙ্গীতের ভাণ্ডার যে কতো সমৃদ্ধ, রাহুল আনন্দ সেটি প্রমাণ করলেন আরেকবার- একটি নাটকের ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে গান-গীতগুলোকে যথাস্থানে স্থাপন করে। এই গানগুলো, সঙ্গে নৃত্যও বটে, এতই আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যে, আমার ধারণা, একজন দর্শক আর কিছুর জন্য না হলেও শুধুমাত্র গানগুলোর জন্যই আরেকবার কইন্যা দেখতে যাবেন!

৬.
আমাদের মঞ্চে সম্পূর্ণ আঞ্চলিক ভাষায় রচিত নাটক নিয়ে খুব বেশি কাজ হয় নি (এই মুহূর্তে মনে পড়ছে হাত হদাই’র নাম। আর কোনোটা?), কাজ হয় নি ধর্মচর্চার ধরন, হয়নি জনজীবনে প্রচলিত দ্বন্দ্ব নিয়েও। প্রাচ্যনাট তার কলাকুশলী নিয়ে এমন একটি দুরূহ কাজ করে দেখাবার সাহস করেছে এজন্যই তারা ধন্যবাদের পাত্র। আর দেখাতে গিয়ে তারা যে তাদের বিপুল পারঙ্গমতার পরিচয় দিলেন, তার জন্য? অভিনন্দন। অভিবাদন

আহমাদ মোস্তফা কামাল ( [email protected]) : কথাসাহিত্যিক

”