এ-বছরও অনেকগুলো নতুন নাটক মঞ্চস্থ হলো। কয়েকটি তার ভালো নাটক। দর্শক ভিড় করেই দেখেছে। বাজার-মিডিয়ার সর্বগ্রাসী ছেনালি সম্পূর্ণ ছিবড়ে করতে পারে নি তাহলে তাদের। বেশিরভাগ দর্শক নবীন-নবীনা, দুর্দম যৌবন অটুট সত্তায়। নাটক আজও যারা করছে, দেখছে তাদের তাই হাজার সালাম। একালের বীর তারা বীর্যবন্ত। বাঁচাবে তারাই তবে তাণ্ডবকালে মানবের প্রাণভোমরা- সত্তাস্বরূপ, জিয়নকাঠি। অমৃত বলহীনের লভ্য তো নয়।

তবে কথা হলো নাটকগুলোয় সেই রশদ মিলছে তো? কতটা মিলছে তারই হিসাব-নিকাশ সেহেতু করতে হবে। – ‘মানের দায় মাথায় রেখো/ জীবনে চাও প্রাণ’-

 

মরিয়াও মরে না রাম

আশা বাঁচে খাণ্ডবেরও পরে?- ধন্য আশা কুহকিনী!

সালতামামি ২০০৬ : মঞ্চনাটক আজিও সম্ভবে

 

প্রাচ্যনাট স্কুল রিপার্টরির ১ম প্রযোজনা কিনু কাহারের থেটার। রচনা- মনোজ মিত্র, নির্দেশনা- কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন। আখ্যান সঙ-আলকাপ ধরনের গ্রামীণ নাট্যরীতির থেটার দল নিয়ে। জমাটি রঙ্গ তামাশায় ক্ষমতাকাঠামোর চিরকালীন ন্যায়নীতিরহিত নৃশংস স্বরূপ খুলে ফেলে। তাতে অনেকগুলো স্তরের গতায়ত চলে দক্ষ বুননে। থেটার দল, তার ক্ষমতা কাঠামো, মহড়া ও অভিনয়স্থলের সমাজকাঠামো- পরস্পর বিন্যাসে জননাট্যের জমজমাট আদল তৈরি হয়। মঞ্চে শেষভাগের মধ্যখানে একটি মাত্র পট টাঙ্গানো- হয়তো কবেকার সংস্কৃত নাট্যরীতির তুখোড় ব্যবহার সাধারণ গরীব মানুষের সৃজন সামর্থ্য।ে কুশীলবগণ গানবাজনা করতে করতে মিলনায়তন ঘুরে মঞ্চের দুপাশে বসে যায়- থেটার হবে এই উঠানে- জানা যায় সূত্রধারের কথায়। বেশ একটা রগড় হবে এমন সাজ সাজ রব ওঠে- মহড়া শুরু হয়।- সব মিলে গ্রামীণ পরিবেশ। মঞ্চে এটা হওয়া কিন্তু সহজ নয়। আজকের ফ্যাশনবাজ নাগরিকজনের পক্ষে। কমবয়সী, নবাগত অভিনেতৃ বলে হয়তো এখনও অনেকটাই সহজ অনারষ্ট হতে পেরেছে- কর্মশালা আর নির্দেশকের সততায়।- ঘটনাঘটন জমপেশ মজাদার।

পুতনা রাজ্যের উজির এক নারীর শ্লীলতাহানি ঘটিয়েছে। লাট সাহেব বলেন- এর যদি বিচার না হয়, তাহলে আমি সিংহাসন ফালাইয়া দিমু। রাজা পড়ে মহা বিপদে, তার যত অপকর্মের দোসর উজিরেরে কী করে চৌদ্দ ঘা চাবুক মারে।- খুঁজতে বলে এমন একজনকে যে নিজে এসে দোষ স্বীকার করবে। চার থলি টাকা নিয়ে ঘন্টকর্ণের বৌ জগদম্বা উজিরের হাতে তুলে দেয় স্বামীকে। তারপর তার বাড়ি লাইন দেয় যত চোর-ডাকাত-দাগীআসামীর দল থলি থলি টাকা নিয়ে। অপরাধ করে তারা আর সাজা ভোগ করে ‘সাজা খেগো অফিসার’ ঘন্টকর্ণ। ভালোই চলে দেশ। হঠাৎ একদিন রাজা ফেঁসে যায় ছাগল খুনের দায়ে। লাট সাহেবের বুদ্ধির প্যাঁচে রাজার হল ফাঁসির আদেশ। রাজা ভাবে ভয় কী- ‘নে রে বাবা ঘন্টকর্ণ, উঠে পর ফাঁসিকাষ্ঠে।’- এর মধ্যে নানা সময় বারে বারে চরিত্র-অভিনেতৃ ঢুকে পড়ে পরস্পরে- জমে ওঠে তী² সব রাজনৈতিক খুনসুটি। রাজা-উজির-লাটবেলাট আর লোককথার ঘন্টকর্ণ জগদম্বা- সব মিলে দেশি বাংলা রীতির এক উপস্থাপন, তার সঙ্গে মেলানো হয় ঘটমান বর্তমানও। এহেন রূপায়ণ সহজকর্ম নয় আজ। এক সময়, আশি দশক পর্যন্ত এরকম নানা রঙ্গব্যঙ্গের রাজনৈতিক নাট্য হতো। ব্রেশটের প্ররোচনায়। আজ সেসব গল্পকথা। আজিকালি নান্দনিক কত সৃজন লম্ফে উল্লম্ফে থিয়েটার ইডিয়মের বিচিত্র বিস্তার স্ফ‚র্তি। রাজনীতি-টিতির দিন গুজার গিয়া- বড়জোর পথনাটকে হলেও হতে পারে- মঞ্চে ওসব স্থূল পশ্চাদপদতা আর নয়। ওসব দিন অনেক আগে পেরিয়ে এসেছি আজ মুক্তবাজারী একুশ শতকে।- মাঝে মধ্যে তাই বুঝি অনভ্যস্ত সৌখিন দর্শক কিছু বেরিয়েও গেছে দেখেছি। নাট্য বড়ই নিরাভরণ, একটি দুটি প্রপস ব্যবহৃত- এই আখানে রূপায়ণে যা মানানসই। বাচন কিছু আরোপিত লাগে- দ্রুততর স্মার্টনেস দর্শকের অভ্যস্ত শ্র“তির সঙ্গে মিলতে সমস্যা করে। বিষয়-ভাষারীতি একে দর্শকের অচেনা, তাতে আরো বিপত্তি ঘটে। তবে শারীরভঙ্গির সহজ গ্রামীণ স্বাচ্ছন্দ্য লাগসই হয়েছে। নবীন অভিনেতৃদল নাগরিকমঞ্চে যতটা অনায়াস স্ফ‚র্তি এনেছে সেটা তারিফযোগ্য। শুরুর গান থেকে একটা প্রত্যাশা জাগে- মাঝেমধ্যে আরও গান যদি হতো তবে মনে হয় আরো জমতো।- তবু সব মিলে প্রাচ্যনাট আর তার নবীন নির্দেশককে সালাম জানাই।

 

কিনু কাহারের থেটার

রচনা : মনোজ মিত্র

নির্দেশনা : কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন

প্রযোজনা : প্রাচ্যনাট স্কুল রিপার্টরি

 

 

বিপ্লব বালা : নাট্যজন, শিক্ষক ও সমালোচক