‘ট্র্যাজেডি’র নতুন ভাষার খোঁজ বাংলাদেশের নাট্য প্রযোজনায়। যেখানে প্রবল ভয়ঙ্কর এক বাস্তব ঘটনা হয়ে উঠেছে যেন শিকড়ের গীতিকা। ‘প্রাচ্যনাট’-এর এই প্রযোজনা ঘুরে গেল স¤প্রতি কলকাতা। ‘ব্রাত্যজন’ আয়োজিত চতুর্থ আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসবে। ‘ট্রাজেডি পলাশবাড়ি’, রচনা ও পরিচালনা আজাদ আবুল কালাম। প্রযোজনায় প্রাচ্যনাট। ‘ডকু-থিয়েটার’, নাকি ‘স্পেস থিয়েটার’? নাকি ‘এক্সপিরিমেন্টাল থিয়েটার’? যে নামেই ডাকা হোক ‘ট্র্যাজেডি পলাশবাড়ি’ নাটকটিকে, নাটকের গোটা বৈশিষ্ট্যটাকে ধরা যাবে না। সন্দেহ নেই, বাংলাদেশের ‘প্রাচ্যনাট’ দলের এই প্রযোজনা আধুনিক থিয়েটারের আন্তর্জাতিক ভাষা তথা প্রকাশশৈলীকে আন্তরিকভাবে আত্তিকৃত করেছে। যা প্রয়োজনবোধে নিউজ-ভিডিওকে মঞ্চে ব্যবহার করেছে, কিন্তু কখনই নিজে ভিডিও-নাটক বা সমতুল্য হয়ে যায়নি, বরং আবিষ্কার করতে চেয়েছে থিয়েটার মাধ্যমটির একেবারে নিজস্ব কিছু শক্তিকে। যা হয়ত পিটার ব্রæকের ‘হলো স্পেস’ ভাবনার খুব কাছাকাছি।   এ নাটকের সেই অর্থে খুব পাকাপোক্ত একটা চেহারা নেই।  বরং নাটক শুরু হয় কিছুটা অগোছালোভাবে। একেবারে গোড়াতেই ঘটে যায় একটি ঘটনা, যেটি সত্যই ঘটেছিল বাংলাদেশের বুকে। ২০০৫ সালে ১১ এপ্রিলে ঢাকার অদূরে পলাশবাড়ি নামের এক জায়গায় ধ্বসে পড়ে এক ছোট ফ্যাক্টরি। স্পেকট্রাম সোয়েটার অ্যান্ড নিটিং ফ্যাক্টরি। সেখানে তখন নাইট শিফটের কাজ চলছিল। সরকারি হিসাবে মারা যায় ৬৪ জন। প্রকৃত হিসাব আরও অনেকটাই বেশি। প্রসঙ্গত, এ নিয়ে যে তদন্ত হয়, তার কমিটির রিপোর্টে ছিল, কোনোও রকম ঝুঁকি মোকাবিলার ব্যবস্থা ছাড়াই ঘটনার তিন বছর আগে ফ্যাক্টরিটি তৈরি হয়েছিল একটি জলাভূমির ওপর। নানা ধরনের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ চাপ দিয়ে অনিচ্ছুকদের, মেয়েদেরও কাজ করানো হতো নাইট শিফটে। এই দুর্ঘটনার ব্যাপারটি ঘটে যায় নাটক শুরুর পাঁচ মিনিটের মধ্যে। ধ্বস পড়ে মঞ্চের পেছনে রাখা সুতোর গাঁটরির সেট। এরই সঙ্গে পর্দায় আসতে থাকে ধ্বসে পড়া স্পেকট্রাম ফ্যাক্টরির বাস্তব ছবি। সঙ্গে টুকরো টুকরো প্রতিক্রিয়া পর্দায়। আহতদের, তাদের পরিজনদের। ওই কারখানায় কাজ করা শ্রমিকদের। এবং তারই মাঝে জানিয়ে দেওয়া যে, তাবৎ বেনিয়াকে পুষে রেখে এতবড় দুর্ঘটনার মুখে যে ঠেলে দিয়েছে শ্রমিকদের, সেই ফ্যাক্টরি মালিক আইনের ফাঁক গলে ঠিক বেরিয়ে গেছে! বোঝা যায়, কোনো ‘কমিটেড’ অবস্থান থেকে এই নাটক নির্মাণে এসেছেন নাট্যকার-পরিচালক আজাদ আবুল কালাম।   এই দুর্ঘটনায় আটকেপড়া মানুষদেরই একজন তারাভান। সে আটকে রয়েছে একটা ছাদ থেকে ভেঙেপড়া সিমেন্টের ‘¯ø্যাব’-এর নিচে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ‘¯ø্যাব’ আর তার শরীরের মধ্যে ব্যবধান কমছে। মৃত্যু এগিয়ে আসছে। এটার দৃশ্যরূপে মঞ্চে একটা ‘ফল্স সিলিং’ তৈরি করেছেন আজাদ। যেটি দুর্ঘটনা মুহূর্তে সশব্দে নেমে এসে ঝুলে থাকে দর্শকের ‘আই-লেভেল’-এর ঠিক ওপরটাতে। আর এই দোদুল্যমান মৃত্যুর এগিয়ে আসার মাঝে মাঝে ছিন্ন-ছিন্ন কবিতার মতো আসতে থাকে তারাভান নামক যুবতীর জীবনের নানা ধূসর মধুর ছবি। সেখানে গ্রামে তার প্রথম ঘর পাতা, সেই স্বামীর পাগল হয়ে যাওয়া, তালাক হওয়া, আবার সেই স্বামীর ঠিক হয়ে ফিরে এসে তারাভানকে কাছে টেনে নেওয়া, তা শরিয়ত-বিরুদ্ধ হওয়ায় মৌলবিদের রোষে পড়া এবং তার হাত থেকে বাঁচতে শহরে চলে আসা। সেখানে সুখের ক’দিন কাটিয়ে ফের তারাভানের স্বামীর পাগল হয়ে যাওয়া। সুতরাং, তারাভানের কারখানায় ঢোকা, সেখানে তার জীবনে অন্য পুরুষের আসা, আবার বিয়ের আয়োজনে ঢোকার এইসব ঘটে অস্তিত্বের অবলুপ্তির মাঝে মাঝে কেটে-কেটে অথচ ছন্দ না হারিয়ে। অদ্ভুত মসৃণতায় যে দুই বাস্তবতা মিলে-মিশে যায় বারবার, তার কারণ আজাদের মঞ্চ ব্যবহারের কুশলতা।   মূলত, কৌণিক সব ‘কম্পোজিশন’ সাজিয়ে, গোটা মঞ্চতলকে একইরকম আধো আলো-অন্ধকার করে রেখে, মঞ্চকে ষড়কৌণিকভাবে ভেঙে নিয়ে মঞ্চের ত্রিমাত্রিকতাকে প্রবলভাবে আবিষ্কার করেছেন তিনি। প্রসেনিয়াম থিয়েটারের ‘পিকচার ফ্রেম’-এর খাঁচাটাকেই যেন ভেঙে ফেলেছেন তিনি। তাঁর এই ‘স্পেস’ থিয়েটারের আদলই আবার ‘এক্সপিরিমেন্টাল’ থিয়েটারে বদলে যায়, দর্শক যখন প্রেক্ষাগৃহের বাইরে বেরোতে গিয়ে দেখে, সেখানেও বাহির পথ আটকে পড়ে আছে কারখানার ভগ্নস্তুপ, ছিন্ন দেহাংশ, কাপড়-চোপড় পাশে কান্না ও আর্তনাদসহ শ্রমিক পরিবারেরা।   এমন প্রবল বাস্তবধর্মী নাটকের সংলাপকে কিন্তু বিষণœতা আর মধুরতায় মেদুর রেখেছেন আজাদ। মনে হয়েছে যেন পূর্ববঙ্গ গীতিকার সংলাপ শুনছে দর্শক। এ শুধু শিকড়ে ফেরা নয়, এ যেন আধুনিক শ্রমিক জীবনকে সেই ন্যায্যতা ফিরিয়ে দেওয়া, যাতে সে ফিরে পেতে পারে মধ্যযুগীয় নায়ক-নায়িকার হৃতগৌরব। আন্তর্জাতিক থিয়েটারের ভাষাকে নিয়ে দেশের লোকজ চেতনায় ফিরে আসাটাই এ নাটকের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক অস্ত্র।   [লেখাটি ‘আজকাল’ পত্রিকা, ২৪ জুন ২০১৫ থেকে সংগৃহিত]   সম্রাট মুখোপাধ্যায়: নাট্যসমালোচক। কলকাতা।