এ লেখার শিরোনামে কিছুটা কূপমÐুকতার গন্ধ পাওয়া যায়। শুরুতে এরকম ভেবেছিলাম যে, ‘প্রাচ্যনাট’ হয়তবা শুধুই প্রাচ্যের নাটক মঞ্চায়নের জন্য এই নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভুল। ‘প্রাচ্যনাট’ মঞ্চে আনলো সময়োত্তীর্ণ এক সমকালীননাটক এ ম্যান ফর অল সিজনস্, যে নাটকের প্রথম মঞ্চায়ন হয় ষাটের দশকের একদম গোড়ায়। রবার্ট বোল্টের লেখা এই নাটকটিকে নির্দ্বিধায় ‘এ প্লে ফর অল টাইম’ বলে আখ্যায়িত করা যায়। আর এরকম সময়োপযোগী আধুনিক শৈলীর মহত্তম একটি নাটক নির্বাচনের জন্য প্রথমেই ‘প্রাচ্যনাট’কে ধন্যবাদ।

নাটকের শুরুতেই ইংল্যান্ডের একজন সাধারণ মানুষের (রাজা কিংবা প্রজা মানুষ সবাই সাধারণ) মুখেই শুনতে পাইÑএই সহ¯্রাব্দের ষোল শতক ছিল সমাজজীবনের নানা ক্ষেত্রে পরিবর্তনের শতক। রাজা অষ্টম হেনরির প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়েছিলেন স্বয়ং পোপ। কিন্তু বিরোধ শুরু হয় যখন ক্যাথারিন কোনো পুত্রসন্তানের জন্ম দিতে ব্যর্থ হন এবং রাজা অষ্টম হেনরি অ্যান বুলান নামে এক নারীর প্রেমাসক্ত হয়ে পড়েন। রাজা তার বিয়ে অবৈধ দাবি করেন এবং বিবাহবিচ্ছেদের জন্য পোপের কাছে প্রস্তাব করেন। পোপের অসম্মতি রাজার জন্য এক বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে ধর্মবোধ, নীতিবোধ এবং রাষ্ট্রচিন্তা সবকিছুকে উপেক্ষা করে রাজা অষ্টম হেনরি ‘অ্যাক্ট অফ সুপ্রিমসি’ বিল পাস করেন এবং ইংল্যান্ডে জন্ম নেয় এক নতুন চার্চ সম্প্রদায় যার প্রধান হন রাজা নিজেই। হায় ধর্ম (রাজার ইচ্ছের কাছে কতো কিছুই তো বিভক্ত হয়, নিশ্চিহ্ন হয় কিংবা জন্ম নেয় আমরা তো কতোই দেখি)। এ ম্যান ফর অল সিজনস্ স্যার টমাস মোর রাজার বিয়েতে সম্মতি দিলেন না। প্রতিবাদও করলেন না। ইস্তফা দিলেন কার্ডিনাসের পদ থেকে। নীরব হয়ে রইলেন তিনি। এই নীরবতাই কাল হয়ে দাঁড়াল। ‘প্রাচ্যনাটে’র এ ম্যান ফর অল সিজনস্ স্যার টমাস মোরের এই নীরবতাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। স্যার টমাস মোর যতই বলুন না কেন ‘নীরবতা সম্মতির লক্ষণ’Ñরাজার তল্পিবাহক মাস্টার ক্রমওয়েল, ডিউক অফ নরফোক, রিচার্ড রিচ এদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াল তা (যা অহরহই ঘটে)। রবার্ট বোল্টের ইংরেজি ভাষায় এ ম্যান ফর অল সিজনস্কে বাংলায় সুখশ্রাব্য করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন যিনি তার নাম শাহেদ ইকবাল। আমি জোর দিয়েই বলবো, শাহেদ ইকবাল নিখুঁতভাবে পালন করেছেন তার দায়িত্ব। তাকে দেখে মনে হলো তিনি খুব তরুণ (আসলেও তিনি তরুণ)। কিন্তু অনুবাদটা করেছেন তিনি খুব মুন্সিয়ানার সঙ্গে। নাটকের নির্দেশক আজাদ আবুল কালাম (আরেক তরুণ, অবশ্য তিনি নিজেকে তা ভাবেন কিনা জানি না)। নাটক শেষে আমি তাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। মুগ্ধ হলেই কেবল এভাবে আলিঙ্গন করা যায়। তার নির্দেশনার দক্ষতা দেখে মনে হয়েছে হাজার বছর ধরে তিনি হাঁটছেন পথ, মঞ্চের পথে। অপূর্ব! তরুণ (কিন্তু মেধাবী) শিল্পীদের কাছ থেকে যথাযথ অভিনয় আদায় করেছেন নির্দেশক, তারাও কী অপূর্ব শৈলীতে পাকা অভিনয় শিল্পীদের মতো মঞ্চে হেঁটেছেন, কথা বলেছেন, শরীরটাকে নানাভাবে ব্যবহার করে প্রকাশ করেছেন সংলাপের দ্বৈত অর্থ। চোখ দিয়ে বুঝিয়েছেন মনের ভেতরের অন্য চিন্তার উপস্থিতি। অসম্ভব আন্তরিকতা, শ্রম, ইচ্ছা- এসব থাকলেই কেবল এরকমটা সম্ভব। মাস্টার ক্রমওয়েলরূপী মুরাদ খান, আপনার সুঅভিনয়ের জন্য অভিনন্দন। শতাব্দী, রিজভী, সঞ্জীবন, শাহনাজ খুশী, ইমন, বৃন্দাবন, জাহাঙ্গীর সমঅভিনন্দন আপনাদেরও প্রাপ্য। ধরে থাকুন। আমাদের মঞ্চের দৈন্য দূর হোক। লেডি এলিস মোরের ভূমিকায় অভিনয় করলেন রোকেয়া প্রাচী। প্রাচীর অভিনয়ের প্রতি আমার ভালোলাগা অনেক দিনের। সে ভালোলাগা আরও সুদৃঢ়ও হলো। নাটকের অন্যান্য চরিত্রের তুলনায় লেডি এলিস মোর চরিত্রের অভিনয়গত উপাদান একটু কমই ছিল। কিন্তু প্রাচী তার সুঅভিনয় দিয়ে স্যার টমাস মোররূপী আজাদ আবুল কালামের পাশে বেশ অনবদ্যভাবেই নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন। আগেই বলেছি নাট্যকার রবার্ট বোল্ট স্যার টমাস মোরকে তাঁর নাটকে উপস্থাপন করেছেন এক মহত্তম মানুষের আদলে। এই চরিত্রে রূপদানকারী অভিনেতা আজাদ আবুল কালাম সেই আদলটাকে যথাযথরূপে অনুধাবন করে অভিনয় করেছেন। মঞ্চ কাঁপানোর জন্য উচ্চৈঃস্বরে অদরকারী চিৎকার তিনি করেন নি কিন্তু দর্শক মেতেছে (দর্শকের একজন হিসেবে আমিও)। তিনি নিজে অভিনয় না করে শুধু নির্দেশনা দিলে আরো ভালো হতো কিনা বিষয়টা নিয়ে ভাবা যেতে পারে (না ভাবলেও কোনো ক্ষতি নেই)।

ভীষণ মুন্সিয়ানা দেখা গেছে নাটকের সেটের পরিকল্পনার ক্ষেত্রে। এমন সুচিন্তিত আর সুনিয়ন্ত্রিত সেট যা নাটকটিকে অত্যন্ত সহজসাধ্য করে তুলেছে। একই মঞ্চসজ্জা যা প্রথমত একটি গির্জা তার সামান্য একটু পরিবর্তন করে কখনো নদীর ঘাট, কখনো পানশালা, কখনো কবরস্থানে রূপ নিচ্ছে। এমন মঞ্চসজ্জার সুনাম তো করতেই হবে। ধন্যবাদ সাইফুল ইসলাম। নাটকটা বুঝে নির্দেশকের চাহিদা বুঝে আপনি খুব ভালো সেট ডিজাইন করেছেন। আলোকপরিকল্পনা ভালো, নিয়ন্ত্রণে একটু ঘাটতি আছে। সামনের প্রদর্শনীগুলোতে তা নিশ্চয়ই ঠিক হয়ে যাবে। সাইফুল ইসলামকে আলোকপরিকল্পনার জন্য আরেকবার অভিনন্দন। প্রক্ষেপণের যথার্থতার কথাটা মনে রাখবেন কিন্তু। আজাদ আবুল কালামের কাছে আমার একটা অনুরোধ, সংগীতের বিষয়টা একটু অন্যরকমভাবে ভাবা যায় কিনা? কেমন যেন যাচ্ছিল না নাটকটার সঙ্গে। দেখেনতো কিছু করা যায় কিনা। সবশেষে দর্শকের কাছে অনুরোধ, যারা স্যাটেলাইটের দাসত্ব করে দেশীয়সংস্কৃতির বিপর্যয় ডেকে আনছি, আসুন আমরা মঞ্চমুখী হই। সমৃদ্ধ করি দেশীয়মঞ্চকে। মঞ্চে ভালো নাটক হচ্ছে। ‘প্রাচ্যনাটে’র এই নাটকটা দেখেই বলুন, আমি সত্য ভাষণ করছি কিনা।

[নাটক: এ ম্যান ফর অল সিজনস্। মূলরচনা: রাবর্ট বোল্ট। অনুবাদ: শাহেদ ইকবাল। নির্দেশনা: আজাদ আবুল কালাম। মঞ্চ, আলো ও পোস্টার ডিজাইন: সাইফুল ইসলাম। পোশাকপরিকল্পনা: কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন। আবহসংগীতপরিকল্পনা: রাহুল আনন্দ। রূপসজ্জা: মোহাম্মদ আলী (বাবুল)। প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ: ১৯৯৯। একটি ‘প্রাচ্যনাট’ প্রযোজনা]

 

মাসুম রেজা ([email protected]): নাট্যকার, নির্দেশক