সমকালীন রাজনৈতিক নাট্যচর্চা ও চিন্তার হালহকিকত তালাশের জন্য এই লেখা। সময় খুব বৈরী। এই বৈরিতার ভেংচিতে যেকোনো লেখাই দুমড়ে মুচড়ে যেতে বাধ্য। এ এমনি এক সময় যখন শিল্প, নাট্যচিন্তা, এই সবকিছুই নিজেদের অভীষ্ট লক্ষ্যের স্ববিরোধিতায় রক্তাক্ত। আরো বেশি আক্রান্ত হবার, আরো কুঁকড়ে যাবার ভয়ে ওগুলো পলাতক। আজকের ভাবুকেরা, নাট্যশিল্পীরা বর্তমানকে মোকাবিলা করার ভাষা হারিয়ে নিজেরা অত্যন্ত দীনহীন, দায়গ্রস্ত ও দেউলিয়া। এমন বিদীর্ণ পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতের ভাবনা খুঁজবো কোথা থেকে, কার কাছ থেকে? সময়ের তরবারিতে এফোঁড়-ওফোঁড় হতে থাকা কিছু বিদীর্ণ সন্ধ্যায় আশার খুঁদকুড়ো সঞ্চয় করা গিয়েছিল এমন চারটি প্রযোজনা (ট্র্যাজেডি পলাশবাড়ি, মেড ইন বাংলাদেশ, ম্যাকাব্রে ও কবর) নিশ্চয় তর্কের দাবি রাখে প্রাণের কাছে। প্রাণ সাড়া না দিলে বুদ্ধি আড়ষ্ট হয়ে বুদ্ধু সাজে। সময়ের কুশীলবেরা পরার্থের নামে ছল-বল-চাতুরিতে ‘ন জানে নিলয়’। তবে শিল্প তার দর্শকের বোধে অবশিষ্ট থেকে যায় জ্ঞানচৌতিশায় অর্থাৎ চিন্তার ছন্দে অর্থপূর্ণ হবার আশায়।
এই মুহূর্তে নাট্যচিন্তাকে ভাষা দিতে অগাস্তো বোয়ালের ক্লাসিক ভাবনার অন্দরে শরণ নেয়া যেতে পারে। আপনাদের নিশ্চয় মনে পড়বে ‘অত্যাচারিতের নাট্যে’র মুখবন্ধে তুলে ধরা তাঁর বিখ্যাত তর্ক: “সব থিয়েটারই রাজনৈতিক। কারণ, মানুষের সব কর্মকাÐই রাজনৈতিক, আর থিয়েটার তাদেরই একটি। যারা থিয়েটারকে রাজনীতি থেকে আলাদা করতে চায়, তারা আসলে আমাদেরকে ভুলের মধ্যে নিক্ষেপ করতে চায়। আর এটিও একটি রাজনৈতিক কৌশল (আমার অনুবাদ) ।”১ নাট্য ও রাজনীতির চিরকালীন অঙ্গাঙ্গি সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে আমাদের মুঠিতে ঢাকার সমকালীন নাট্যচর্চা থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু চিহ্ন কেবল তুলে নিতে সক্ষম হতে পারি। বাছাইয়ের এই সক্ষমতা নিশ্চিতভাবেই একটি সমালোচকীয় অবস্থানের রাজনৈতিকতাকে নির্দেশ করে। যেকোনো বাছাই অন্তস্থ প্রক্রিয়ার কারণেই সীমাবদ্ধ। এ জন্যই এই লেখার তত্ত¡গত গঠনপ্রণালী প্রশ্নাতীত নয়। আর সে কারণেই তর্কস্বরূপ চারটি প্রশাখায় লেখাটি বিন্যস্ত হলো। বিশ্বাসে বস্তু মিলে, তর্কে মিলে নির্বস্তুক ভাব। ভাব স্বভাবতই প্রশ্নবিদ্ধ হতে অভিলাষী।
১ম তর্কের প্রসঙ্গ ‘ট্র্যাজেডি পলাশবাড়ি’ : আবেগের রাজনৈতিক ফাঁদ
যৌবনের রক্তপ্রবাহে সঞ্জীবিত একটি দল প্রাচ্যনাট। তাদের সাম্প্রতিক প্রযোজনা ‘ট্র্যাজেডি পলাশবাড়ি’। নৈর্ব্যক্তিক বর্ণনা ও চরিত্রাভিনয়ের ভেদ-অভেদাত্মক দেশজ নাট্যকৌশলের প্রয়োগ এর পাÐুলিপি ও মঞ্চরূপায়ণের ভাষাকে গড়ে তুলেছে। এটি
লিখেছেন ও পরিচালনা করেছেন আজাদ আবুল কালাম। পোশাক, কারখানা-ভবনধ্বসের সাম্প্রতিক বিভীষিকাময় ঘটনাগুলোর বয়ান, এমনকি পাÐুলিপি/নাটক, অভিনয়, ডিজাইন ও পরিচালনার কারিগরি দিকগুলোর তথাকথিত সার্থকতা-ব্যর্থতার কাসুন্দি গাইবো না। প্রযোজনাটির নৈতিক শক্তি ও রাজনৈতিক তাৎপর্য উপলব্ধির প্রয়োজনীয়তা আছে। এই ফুরসত নিশ্চয় আমাদেরকে ভুলতে দেবে না যে, কেবল তখনি একটি শিল্পকর্মের ব্যাখ্যা প্রসারিত হয়, যখন সর্বাগ্রে এটি শিল্প হয়ে ওঠে, শিল্পের দায় পূরণের নানা শর্তের সাথে বোঝাপড়া করতে এটি পারঙ্গম থাকে।
আমেরিকান নাট্যকার আর্থার মিলার ১৯৪৯ সালে ‘ডেথ অফ এ সেলসম্যান’ নাটকের ভূমিকা হিসেবে ‘ট্র্যাজেডি এ্যান্ড দ্য কমন ম্যান’ প্রবন্ধে যা যা বলেছিলেন, তার টুকরো টুকরো এখানে আমার নিজের অনুবাদে দরকারমাফিক তুলে ধরবো। মিলার যেমন বলছেন, আমি মনে করি, এটাই সেই সময়, যখন আমাদের কোনো রাজন্য নেই কিন্তু আমরা আমাদের ইতিহাসের উজ্জ্বলতম [ট্র্যাজেডির] ধারাটিকে তুলে ধরতে পারি, একে এগিয়ে নিতে পারি একমাত্র সাধারণ মানুষের হৃদয় ও মনমানসিকতা প্রতিফলিত করে আর এতে আমাদের সময়কেও আমরা চিনে নিতে পারবো।২ আজাদ আবুল কালাম এই সাধারণ মানুষের স্পিরিটকেই ‘পলাশবাড়ির ট্র্যাজেডি’তে তুলে ধরেছেন। পোশাক কারখানার শ্রমিক, যে আবার একই সাথে নারী, সে হলো শ্রমিক শ্রেণী বা সর্বহারার মধ্যেও সর্বহারা। শ্রমিকেরা দুনিয়ার দলিত শ্রেণী। দলিতদের মধ্যে দলিততম হলো নারী শ্রমিক। আমেরিকা অভিবাসী ভারতীয় বাঙালি বুদ্ধিজীবী গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক দলিত বা নি¤œবর্গ নারী ভুবনেশ্বরী ভাদুড়ীর আত্মহত্যার একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। বাঙালি রাজনৈতিক কর্মী ভাদুড়ী ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে দলের নির্দেশে একটি খুন করতে নারাজ ছিলেন। পরিস্থিতি এমন হয় যে, আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকে না তার কাছে। আত্মহত্যার জন্য মাসিক ঋতুস্্রাব পর্যন্ত অপেক্ষা করেছেন ভাদুড়ী যাতে কেউ তাকে সতীত্বহানির অপবাদ দিতে না পারে। যদিও তার মৃত্যুর পর ক্ষমতাবান অভিজাত শ্রেণী ও তাদের কুক্ষিগত মিডিয়া প্রচার করেছিল যে, সে গর্ভবতী হয়ে শোক সইতে না পেরে আত্মহত্যা করে। উচ্চ শ্রেণীর এই বানানো গল্প তখন বিশ্বাসযোগ্যও হয়েছিল পাবলিকের কাছে। ভাদুড়ি নিজের আত্মহত্যার রাজনৈতিক মাত্রা উন্মোচন করে নিজের স্বর শোনাতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। এই দৃষ্টান্তের মাধ্যমে গায়ত্রী স্পিভাকের চিন্তার যে সরল মর্ম আমরা উদ্ধার করতে পারি তা হলো, নি¤œবর্গ বা দলিত শ্রেণী সর্বদা সামজিক চলিষ্ণুতার বাইরে থাকে, চিহ্নিত করা যায় এমন ক্রিয়ার গড়ন-ধরন কখনোই নি¤œবর্গকে এর ভেতরে ঢুকতে দেয় না। নি¤œবর্গ নিজের ক্রিয়াকর্মকে কখনোই শক্তপোক্ত ভিত্তিও দিতে পারে না। তথাপি মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক চর্চার ভেতরে দলিত নারীর জীবনকে হাজির করতে ও তার স্বর শ্রæতিগোচর করাতে প্রাচ্যনাট ‘ট্র্যাজেডি পলাশবাড়ি’ নাটকটির মাধ্যমে তৎপর হয়েছে।
কিন্তু নারী, বিশেষ করে যখন সেই নারী নি¤œবর্গ বা দলিত তখন তার স্বরটি শ্রেণীগত ও পুরূষতন্ত্রগত কারণে বাস্তবে কতটুকু শোনা যায়? আজাদ প্রতিরূপায়ণে (রিপ্রেজেন্টেশনে) দলিত নারীর স্বর শোনাতে [নিশ্চিতভাবেই দেখাতে] এই নাটক
লিখেছেন ও প্রাচ্যনাটের অধিকতর তরুণদের নিয়ে উপস্থাপনও করেছেন। কাব্যের আঙ্গিকে বর্ণনা ও সংলাপের মিশেলে ঢাকায় বর্তমানে খুব চালু ফর্মটিকেই তিনি বেছেছেন। নাটকের দলিততম নারীর স্বর শোনাবার লক্ষ্যে আজাদ উপলক্ষ্য হিসেবে বেছে নিয়েছেন আন্তর্জাতিক লগ্নির যোগসাজশে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের পোশাক ব্যবসার একটি ক্ষেত্রকে, পোশাক কারখানার একটি ভবনধ্বসের ঘটনাকে, ধ্বসে পড়া ভবনের ধ্বংসস্তূপের নিচে এক নারীর অন্তিম জীবনকে। নাটকের তারাভান নামের মেয়েটি জীবন ও মৃত্যুর চরমতম সন্ধিস্থলে একটা রুদ্ধশ্বাস উৎকণ্ঠার আবহে নিজের জীবনের কথা বলছে, যখন ওর নিজেরই জীবন নিঃশেষ হতে চলেছে। গার্মেন্টস শ্রমিক মেয়েটির প্রাণান্ত কথনের ভেতরে দগদগে হয়ে ওঠে ব্যক্তি হিসেবে সমাজে ওর যথার্থ অবস্থান খুঁজে পাবার বাসনা। এটা হলো মানুষ হিসেবে মেয়েটির মর্যাদার প্রশ্ন। আর্থার মিলার একে যেমন বলেন, সেন্স অফ পার্সোনাল ডিগনিটি।৩ “ওরেস্তেস থেকে হ্যামলেট, মিডিয়া থেকে ম্যাকবেথ প্রত্যেকের নিহিত সংগ্রামের মধ্যেই লক্ষ্য করা যায় নিজের সমাজে যথাযথ অবস্থান অর্জন করতে ব্যক্তি প্রাণপণে চেষ্টারত।”৪ গাইবান্ধার পলাশবাড়ি থেকে সাভারের পলাশবাড়ি পর্যন্ত আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে মেয়েটির একজীবনপরিক্রমার মধ্যে বিধৃত হয় এই তীব্র প্রচেষ্টা। এভাবেই এই নাটকের ট্র্যাজেডি সংঘটিত হয়। ‘ট্র্যাজেডি পলাশবাড়ি’ উপলক্ষে মিলারের চিন্তার প্রাসঙ্গিকতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বলা যাবে, “তাহলে নিজেকে ন্যায়সঙ্গতভাবে মূল্যায়নের জন্য ব্যক্তির সর্বাঙ্গীন বাধ্যবাধকতারই ফলাফল হলো ট্র্যজেডি।”৫ পলাশবাড়ির মেয়েটির বাধ্যবাধকতা স্ফূট হয় গ্রাম থেকে শহরের অভিবাস, আবার প্রেম, পুনরায় বিয়ে, বাঁচার জন্য কাজের উল্লাসের মধ্যে তার দুই জীবনের রূপান্তরের প্রক্রিয়ায়। ধ্রæপদী গ্রিক ট্র্যাজেডির মহান রাজন্যদের মহিমময়জীবন যেমন অদৃষ্টের ক্রীড়নক, তেমনি মতই যেন ‘ট্র্যাজেডি পলাশবাড়ি’র শ্রমজীবী সাধারণ মেয়েটির জীবনের পরিণতি যেন বড়ই নিয়তিচালিত। অথচ এই নাটকের আদিতে কেন্দ্রীয় চরিত্র তারাভানের জীবনের আর্থ-সামাজিক প্রতিকূলতার শর্তগুলো এদও শুঁড় তুলছিল। তবুও অবশেষে মেয়েটির জীবনের পরিণতি আমাদেরকে, আমাদের সময়কে, আমাদের তুচ্ছ অস্তিত্ত¡কে করুণা ও ভীতি জাগানিয়া ট্র্যাজেডিরই মুখোমুখি করে। কারণ, ভবনধ্বসে মেয়েটির মৃত্যুকে সমস্যাজনকভাবেই নিয়তিতাড়িত মনে হয়। অথচ নাটকের আদি-মধ্য জুড়ে কী অসাধারণভাবেই না মেয়েটিকে ইচ্ছা ও কর্মের স্বাধীনতা দিয়ে চালিত হতে দেখা গেছে। কিন্তু নাটকটি ক্রমে ক্রমে এমন এক পরিসমাপ্তির দিকে গেছে, যাতে শেষপর্যন্ত মনে হয় মেয়েটি কপালকুÐলা, ভাগ্যলাঞ্ছিতা, নিয়তির ক্রীড়নক নিদারুণ অসহায়া অবলা পুত্তুলি। নাটকের এই পরিণতি ও দর্শকের মধ্যে এই বোধের সৃষ্টির মধ্যদিয়ে পলাশবাড়ি উপরতলে ট্র্যাজেডি। কারণ এই নাটক, এর অভিনয় ও উপস্থাপনার অন্যান্য অনুষঙ্গ সবকিছুই যথেষ্টভাবে তৎপর থেকেছে দর্শককে কেন্দ্রীয় চরিত্রের সাথে সমানুভূতিপ্রবণ (এমপেথিক) করতে। দর্শকের বুকের কাঁপন চোখের ছলছল কেন্দ্রীয় চরিত্র (প্রোটাগনিস্ট) মেয়েটির জীবনের বিয়োগান্তকতার প্রতি সমানুভূতিমূলক এক সর্ম্পককেই হাজির করে। কিন্তু এর ফলে এই নাটকের এই ট্র্যাজেডির সম্ভাব্য আরেকটি মাত্রা, আরেকটি কেন্দ্রীয় [খল] চরিত্র আমাদের আপ্লুত হওয়ার অবকাশযাপনের প্রক্রিয়ার ভেতরতল দিয়ে ফসকে গেছে। বেমালুম
গায়েব হয়ে যাওয়া এই চরিত্রটি কোনো ব্যক্তি নয়। এক ব্যবস্থা। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। নাটকের ভবনধ্বস নিছক কোনো দুর্ঘটনা নয়। পুংলিঙ্গীয় উত্তেজনাতাড়িত উদ্বৃত্তমূল্যতাত্তি¡ক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার (লিবিডোনাস ইকোনোমিকসের) মুনাফাখোর দাঁতাল কপাটির প্রতীক এই ভবনধ্বস। অথচ এই ট্র্যাজেডির সংঘটনের অর্থনীতিক ও সমাজতাত্তি¡ক শর্তগুলোই ক্ষীণতর হয়ে অবশেষে অব্যাখ্যাত থেকে যায়। এমনকি, প্রযোজনায় প্রজেকশনের মাধ্যমে বহির্দেশীয় বিশ্লেষকের আবির্ভাব ঘটানো হলেও তা ব্যাখ্যামূলক নয়, বরং মিমিক্রি হয়ে ওঠেছে।
গরিবি, শোষণ, অস্থিরতা, ক্ষমতার অসম বিন্যাস, অধস্তনতা, পরিবেশের নিঃশেষকরণ, সম্পদ ও ক্ষমতার অসাম্য এই সবই পুঁজিবাদের অবিচারকে তুলে ধরে। এই অবিচারের নানান ভয়ঙ্কর প্রকাশের একটি এই ভবনধ্বস। পুঁজিতান্ত্রিক এই অবিচারের ব্যবস্থাগত ইতিহাসের একটি বিশেষ পর্যায়ে, এ ধরনের ট্র্যাজেডি অনিবার্য হয়ে ওঠে। এই ট্র্যাজেডি পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার সমুদয় শর্তের যোগফল। অথচ এই নাটকে ট্র্যাজিক ফলাফল তৈরি হয়েছে কিন্তু এর সেইসব আর্থ-রাজনৈতিক-সামাজিক শর্ত ও পুঁজিতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটি উন্মোচিত হয়নি।
লুই আলথুসার ‘অন আইডিওলজি’ বইয়ে ভাবাদর্শ বিষয়ে বলতে গিয়ে শিল্প ও ভাবাদর্শের সম্পর্ক নিয়ে যা লিখেছেন তা থেকে আলোকিত হয়ে এখানে প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়: “আমি জানি শিল্পী ও শিল্পপ্রেমীরা সৃষ্টির লক্ষ্যে নিজেদেরকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ করে। এটা একটা ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ ভাষা কিন্তু মার্কস ও লেনিন থেকে আমরা জানি প্রতিটা ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ ভাষা আাদতে একটা ভাবাদর্শিক ভাষা।”৬ কিন্তু প্রশ্ন হলো আলোচ্য নাট্যকর্মটি কোন ভাবাদর্শের ভাষা? আমার তর্ক হলো, এই প্রযোজনা সজ্ঞানে (কনশাসলি) যে ভাবাদর্শের বিরোধিতা করেছে অজ্ঞানে (আনকনশাসলি) সেই ভাবাদর্শেরই ভাষা হয়ে ওঠেছে। কিন্তু সেটি কীভাবে? আবারও আলথুসারকে ভর করে এই প্রস্তাবকে পর্যালোচনা করা যেতে পারে। আলথুসার বলেন, শিল্পের ব্যতিক্রমী দিকটি হলো এটি “আমাদেরকে দেখায়” (মেক আস সি), “আমাদেরকে অনুধাবন করায়” (মেক আস পারসিভ), “আমাদেরকে অনুভব করায়” (মেক আস ফিল) এমন কিছু যা বাস্তবকে পরোক্ষে ইঙ্গিত করে।”৭ বালজাক ও সোলঝেনেৎসিনের উপন্যাসের দৃষ্টান্ত দিয়ে তিনি বলেছেন, এগুলোও তাই করেছে। কিন্তু যা করেনি তা হলো, বাস্তবকে জ্ঞাত করেনি (নট নো)। জ্ঞাত করানোর প্রক্রিয়াটি তখনি শুরু হয়, যখন ভাবাদর্শিক স্বতঃস্ফূর্ততার ভাষার সাথে, আর সকল জ্ঞানের মতোই, শিল্প সংক্রান্ত [অধিপতিশীল] জ্ঞানেরও একটি বিচ্ছেদ ঘটানো বা ফাটল তৈরি করা সম্ভবপর হয়।৮ “আমি এখন বিশ্বাস করি শিল্পের সত্যকার জ্ঞানে পৌঁছানোর একমাত্র পথ হলো একটি শিল্পকর্মের প্রজাতিগত পুঙ্খানুপুঙ্খতার নির্দিষ্টতার এক্কেকবারে গভীরে যাওয়া, কোনো কৌশল/অবস্থা/পরিস্থিতি ‘নান্দনিকতার প্রভাব/ইফেক্ট’ তৈরি করে তা জানা।”৯ আলথুসারের মোদ্দা কথা হলো শিল্প সংক্রান্ত আধিপত্যকামী জ্ঞানের বিরোধিতার মাধ্যমে অন্য জ্ঞানের হদিশ নেওযা। প্রচলিত অধিপতিশীল জ্ঞানের ক্রীতদাসত্ব বরণ না করে শিল্পের আলোচনা-পর্যালোচনাকেই কেবল শিল্প বিষয় ওই অন্য জ্ঞান বলা যথেষ্ট নয়। বরং এই নাটকের পুরো প্রেক্ষাপট, এই ট্র্যাজেডি সংঘটনের সামগ্রিক বাস্তবতা সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়াও শিল্পসৃষ্টি সংক্রান্ত ওই অন্য জ্ঞানেরই অন্বেষণ করা। সেকারণেই পলাশবাড়ির ট্র্যাজেডি সংঘটনের ব্যবস্থাগত বাস্তবতার হদিশ নেওয়া দরকার, অথচ সে খোঁজ অনায়াসে আমরা এই নাটক থেকেই পেতে পারতাম।
রবিন হুহনেলের ‘অল্টারনেটিভস টু ক্যাপিটালিজম: প্রপোজালস ফর এ ডেমোক্রেটিক ইকোনমি’ বইয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে উঠে এসেছে পুঁজিবাদ বিরোধী পার্টিসিপেটরি ইকোনমিক্স বা অংশগ্রহণমূলক অর্থনীতির একটি মডেল।১০ এই মডেল থেকে আমরা অবশ্যই জ্ঞাত হতে পারি যে, শ্রমিক এবং সোপানে সোপানে বিভক্ত শ্রম সংগঠন অংশগ্রহণমূলকভাবে অর্থনীতিকে গড়ে তুলতে থাকে। কিন্তু এর ফলভোগের একচেটিয়া ধরন একে কার্যত অগণতান্ত্রিক ও বৈষম্যের এক ব্যবস্থায় পরিণত করে। আদতে বাজার ব্যক্তিগত, মালিকানা ও প্রাধান্যপরম্পরাভিত্তিক (হায়ারার্কিক্যাল) শ্রম বিভাজনের বিভীষিকাময় ব্যবস্থাই স্পেকট্রাম ফ্যাক্টরি ভবনধ্বসকে সংঘটিত করে। এই ভবনধ্বস ও পলাশবাড়ির এই মেয়েটির মৃত্যু পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার অর্ন্তনিহিত প্যারাডক্স বা নৈতিকতাজনিত অস্বীকারেরই প্রকাশ।
¯েøাভেনিয় মার্কসবাদী চিন্তক ¯øাভো জিজেক মুক্তবাজার ব্যবস্থাকে একধরনের মৌলবাদ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।১১ নিউ এপিপিএস অর্থাৎ আর্ট পলিটিক্স ফিলসফি সাসেন্স নামের এই বøগে তিনি গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদের ‘চিরস্থায়ী’ বিবাহবন্ধনকে তালাকের কাছাকাছি বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে বৈশ্বিক পুঁজিবাদ একটি জটিল প্রক্রিয়া। এতে একেক দেশ একেকভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। আজকের বৈশ্বিক পুঁজিবাদের সাধারণ প্রবণতা হলো বাজারের আরো বিস্তৃতি, সর্বজনের জায়গাগুলোর দখল, সর্বজনের সেবাখাতগুলোর [যেমন স্বাস্থ্য শিক্ষা সংস্কৃতির] ক্রমে ক্রমে সংকোচন এবং ধাই ধাই করে বাড়ন্ত কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক ক্ষমতা। প্রদর্শিত নাটকটির পরিণতির বিপরীতে এসে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি, পলাশবাড়ির তারাভানের ট্র্যাজেডির কারণ চরিত্রের অদৃষ্টে নয়, বরং বৈশ্বিক পুঁজিবাদের উল্লিখিত এই জটিল প্রক্রিয়ার ভেতরে সুপ্ত আছে। ব্যথিত হওয়ার ব্যাপার হলো, এই কারণ যেটি নাটকে নেই কিন্তু বাস্তবের সম্যক বিশ্লেষণে দেখতে পাওয়া যায় তা আছে। বাংলাদেশ শুধু সস্তা শ্রম বাজার নয়, সস্তায় শ্রম কেনার মাধ্যমে, বৈশ্বিক পুঁজির লগ্নিতে উৎপাদিত নানা পণ্য কেনার জন্য স্থানীয়ভাবে একটি নতুন বাজারেও পরিণত হতে চলেছে। এর মাধ্যমে গার্মেন্টস শ্রমিকেরাও শ্রম বিক্রি ও ভোগের একটা লিবিডোনাস অর্থনীতির চক্করে পড়ে। বার্টল্ট ব্রেখটের ‘দ্য মেজারস টেকেন’ নাটকের ‘মানুষ কী’ নামক পঞ্চম দৃশ্যে একজন ব্যবসায়ী তার কাছে অভ্যাগত তরুণ কমরেডকে বলে, আমি আমার কারখানার শ্রমিককে ততটুকুই মজুরি দিই, যাতে সে আমার ক্যান্টিন থেকে নি¤œমানের চাল কিনে খেয়ে আমার জন্যই আবার কাজ করতে পারে। আসলে একজন ব্যবসায়ী একজন শ্রমিককে যতটুকু মজুরি দেয়, আবার খাবার [পণ্য] বিক্রির মাধ্যমে ততটুকু সে হাতিয়েও নেয়। কারণ, মানুষ কী তা একজন ব্যবসায়ী জানে না, তবে মানুষের বাজারদর কত তা সে জানে। এই দর-ধরা বাজারে হারায় শুধু শ্রমিক। উৎপাদিত পণ্য থেকে মুনাফার মাধ্যমে, উদ্বৃত্ত মূল্যের স্ফীতির চক্রের মাধ্যমে, পুঁজিপতির লগ্নি ও সঞ্চয় কেবলি কুষ্ঠরোগীর দগদগে অসুখের মতন আরো স্ফীত হতে থাকে। শ্রমিকের সর্বহারা হবার প্রক্রিয়া তো তাই। রাষ্ট্রের মধ্যস্থতা, আমেরিকা ও ইউরোপের ‘ট্রেড ইউনিয়ন’ ও ‘মানবাধিকার’ ওষুধপত্র প্রভৃতি চাপসৃষ্টিকারী উপাদানগুলোর উপস্থিতিতে বাংলাদেশের অতি দারিদ্রকবলিত ও পুরূষতান্ত্রিকতা দিয়ে শাসিত গ্রামগুলোর মেয়েরা আপাতভাবে ‘স্বনির্ভরতার সুখ’ ও ফেয়ার এন্ড লাভলীর ফর্সা মুখের দাওয়ায় নাগালে পেলেও, বাসনার নতুন নতুন চক্কর কিন্তু তাদেরকে ছাড়ে না। ভোগ-বাসনার সৃষ্টি ও বাজার বৃদ্ধিও পারস্পরিক সম্পর্কিত কায়দা আাসলে দর-ধরা ব্যবসায়ী ব্যবস্থারই একটি অভিব্যক্তি মাত্র।
এমনকি বৈশ্বিক পুঁজির যে স্থানীয় মধ্যস্বত্বভোগী গার্মেন্টস মালিক শ্রেণী, তারাওতো এই বাজারদরভিত্তিক বাস্তবতার ঈশ্বরতুল্য স্থানীয় নিয়ামক। ফলে এই শর্ত ও প্রক্রিয়াকে অনুধাবন নিশ্চিতভাবেই রাজনৈতিক শিল্পের জ্ঞানগত কর্ম। এই কর্ম সম্পন্ন হয়েছি কি? প্রযোজনাটি ঘিরে আমাদের সেই প্রশ্নের উত্থাপন করা দরকার।
মোদ্দাকথা হলো, আবেগের ঘনীভবন নিশ্চিতভাবে পুঁজিবাদের ভাবাদর্শিক ভাষাকেই তুলে ধরে। কারণ সমানুভূতি, [ট্র্যাজেডি পলাশবাড়ি] নাটকে নির্মিত কাহিনীর প্রতি আপ্লুত করে রাখে দর্শককে। দর্শক তখন বাস্তব থেকে মুখ ফিরিয়ে শোকে বিহŸল থাকে। আর পুঁজিবাদের লক্ষ্যই তাই। দর্শকের চিন্তার পক্ষাঘাতগ্রস্ততার ভাবাদর্শই পুঁজিবাদের সাংস্কৃতিক ভাবাদর্শ। এমপেথি অর অসমোসিস অধ্যায়ে বোয়ালের বিশ্লেষণ পাঠের মাধ্যমে আমরা তাই শিখতে পারি।১২ বার্টল্ট ব্রেখট যেমন এপিক থিয়েটার ও ড্রামাটিক থিয়েটারের পার্থক্য উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, নান্দনিক অভিজ্ঞতার মাধ্যমে দর্শককে সেনসেশন বা সংবেদনগ্রস্ত করার বিপরীতে বরং পৃথিবীর বাস্তবতা সম্পর্কে একটা সম্যক চিত্র তুলে ধরে, যুক্তিশীল সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা জাগিয়ে দর্শককে সমাজ রূপান্তরের কর্মে উদ্বুদ্ধ করা যায়। ট্র্র্যাজিক ফলাফলরূপে ট্র্রাজেডি পলাশবাড়ি পুঁজিতন্ত্রের সাংস্কৃতিক ভাবাদর্শের ইচ্ছামাফিক নিজের অজান্তেই অতিশয় আবেগ উৎপাদনে যারপর নাই নিবিষ্ট থেকেছে। এর ফলে, দর্শক শোকার্ত হয়েছে, সম্যক বাস্তবতা নিয়ে চিন্তিত হয়নি। নিশ্চিতভাবেই আবেগপ্রবণতা ও চিন্তাশীলতার দ্বা›িদ্বক বিরোধ এই নাটকের মৌলিক প্রভাব হতে পারতো। পুঁজিতন্ত্রের আবেগ-উৎপাদনী সাংস্কৃতিক রাজনীতির ফান্দে পড়া ‘ট্র্যাজেডি পলাশবাড়ি’-র দর্শককে আস্তিনে লুকানো আবেগের পুঁটলি হিসেবে [আনকনশাসলি] অনুমান করেনি শুধু, দর্শককে এমন মানুষ হিসেবে ভাবা হয়েছে যে, সে এক স্থির বিন্দু। অথচ মানুষ এক প্রক্রিয়া। তার রূপান্তরের শক্তি অসীম।১৩
তথ্যসূত্র:
- Augusto Boal, Theatre of the Oppressed, (Translated from the Spanish by Charles A. & Maria-Odilia Leal McBride), Pluto Press, London 1979, p. ix
- Arthur Miller, “Tragedy and the Common Man” , David Krasner ed. Theatre in Theory 1900-2000, Blackwell Publishing, USA, 2008, p. 269
- 3. পূর্বোক্ত, 267
- পূর্বোক্ত, p. 267
- 5. পূর্বোক্ত, 267
- Luis Althusser, On Ideology, p. 178
- পূর্বোক্ত, p. 174
- পূর্বোক্ত, p. 178
- পূর্বোক্ত, p. 179
10.http://www.newleftproject.org/index.php/site/article_comments/alternatives_to_capitalism_introductio
11.http://www.newappsblog.com/2013/07/slavoj-%C5%BEi%C5%BEek-on-todays-capitalism.html
- Augusto Boal, পূর্বোক্ত, pp. 113-115
- John Willett (edited and translated), Brecht on Theatre The Development of an Aesthetics, Hill and Wang, New York, 1964 p.37
শাহমান মৈশান: নাট্যকার কবি ও প্রাবন্ধিক। সহকারী অধ্যাপক, থিয়েটার এন্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।